নিউজ ডেস্ক :: শরিয়ত বাউলকে আইসিটি আইনে গ্রেফতার করে জেলখানায় রাখা হয়েছে অথচ সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর সপক্ষে ওয়াজকারী মিজানুর রহমান আজহারী কীভাবে দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারল তা নিয়ে সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।
তিনি বলেন, আজহারী সম্পর্কে ধর্মমন্ত্রী বলেছেন তিনি জামায়াতের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন। আইসিটি আইনে তাকে গ্রেফতার করা হয়নি বরং তাকে নির্বিঘ্নে মালয়েশিয়ায় চলে যেতে দেয়া হয়েছে। শরিয়ত বাউলকে আইসিটি আইনে গ্রেফতার করে জেলখানায় রাখা হয়েছে।
সোমবার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণ সম্পর্কে আনীত ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে একথা বলেন তিনি।
মেনন বলেন, আমাদের দেশে শরিয়ত ও মারফতের দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো। এখন সৌদি-পাকিস্তানি ও জামায়াতিদের ওহাবিবাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করতে এ ধরনের দ্বন্দ্বের সম্পর্কে যখন রাষ্ট্রীয় আইন ব্যবহার করা হয়, তখন উদ্বেগের বিষয়। রাষ্ট্র কী অতীতের মতো আবার মৌলবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে? না হলে আজহারী দেশ ছেড়ে যেতে পারে না। খতমে নবুয়ত নতুন করে হুঙ্কার ছাড়তে পারে না। হেফাজত সমর্থন প্রত্যাহারের হুমকি দিতে পারে না। এরাই কদিন পর পাকিস্তানি কায়দায় ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন করতে বলবে, যেমন এ সংসদেই যুদ্ধাপরাধী নিজামী সেই প্রস্তাব তুলেছিলেন।
তিনি বলেন, আমি শুরুতেই বলেছি বঙ্গবন্ধু এদেশকে ধর্মনিরপেক্ষতার মূল নীতি উপহার দিয়েছিলেন। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের বিরুদ্ধে তিনি কেবল সোচ্চার ছিলেন না, বাস্তবে তার অনুসরণ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিলে আইন তার ব্যবস্থা নেবে। আমি এ সংসদে স্পিকারের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে ইউটিউবে প্রচারিত ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টি ও বিভাজনের কিছু বক্তব্যের পেন-ড্রাইভ দিয়েছিলাম। সেসবের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে জানা নেই। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই তারা মরিয়া আক্রমণ করবে। ধর্মবাদী তো বটেই, ওই ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে ডান ও তথাকথিত বামও এক হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বাঙালি জাতি পরিচয়ের ব্যাপারে তিনি এতটুকু দ্বিধায় ভোগেননি। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের নামে যে ধর্মীয় আবরণ দিয়ে তাকে পাকিস্তানি আদলে ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা হয়েছিল, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তার ছেদ ঘটানো হয়েছে। কিন্তু সেই প্রচেষ্টার অবসান হয়নি। রাষ্ট্রীয় প্রচারে, আমাদের আচার আচরণে, বেশভূষার পরিবর্তনে তার রেশ আমরা দেখি। ফেসবুক, ইউটিউবের নিত্য প্রচারে সেই মনমানসিকতাকে উসকে দেয়া হচ্ছে প্রতিদিন। ভাষা আন্দোলন যেমন আমাদের জাতিসত্তাকে নির্দিষ্ট করেছে, তেমনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুও নির্দিষ্ট করে বলেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’
তিনি বলেন, মাধ্যমিক ক্ষেত্রে শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন করা হচ্ছে বলে প্রকাশ পেয়েছে। এ নিয়ে কোথায় আলোচনা হয়েছে বলে জানা নেই। বিএনপি-জামায়াত আমলে একমুখী শিক্ষার নামে মাধ্যমিক সাধারণ শিক্ষার অবনমনের ষড়যন্ত্র হয়েছিল। বিজ্ঞান, গণিতকে পিছে ঠেলে শিক্ষা ধর্মীয় ও ব্যবসায়ীভিত্তিক করার চেষ্টা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর শাসনামলে সে ধরনের পশ্চাৎপদগামিতা হবে না আশা করি। তারপরও এ নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষাবিদ, বিশেষজ্ঞ নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। কিছু করার আগে প্রয়োজন সংসদে আলোচনা। পাঠ্যবইয়ে হিন্দু লেখকদের লেখা তুলে দেয়া, গল্প-কথা-চিত্রে ধর্মভাবের প্রতিফলনের নতুন সব ব্যবস্থা আমাদের আতঙ্কিত করে। সেই ছোটবেলায় আমাদের মধ্যে পাকিস্তানি ভাব আনতে, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি’ বলে পড়ানো হতো। সেই ভাবটাই নিয়ে আসা হচ্ছে পাঠ্যবইয়ে।
তিনি আরও বলেন, অর্থমন্ত্রী সংসদে অর্থনীতির ভালো অবস্থার কথা বললেও, বাইরে স্বীকার করেছেন যে রফতানিসহ অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক নেতিবাচক। বিরোধী সদস্যরা তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থমন্ত্রী না বলায় তিনি দুঃখ পেয়েছেন। তবে ‘বৃক্ষ তোর নাম কি, ফলে পরিচয়’। জুন মাসের বাজেট অধিবেশন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে বৈষম্য কী পরিমাণ বেড়ে যাবে তা দেখার বিষয়। আয়বৈষম্য এখন বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ব্যাকিং খাতের দুরবস্থার কথা না বললেই নয়। সরকার এ বছর ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ ঋণ নেয়ার কথা অর্থবছরের ছয় মাসেই তা প্রায় নেয়া হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণ ১১ বছরে সর্বনিম্ন। এই ঋণ প্রবৃদ্ধি ৯.৮৩ শতাংশ। ঋণ খেলাপি বাড়বে না বলে অর্থমন্ত্রী যে দাবি করেছিলেন তা মিথ্যা প্রমাণ করে গত এক বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার ওপর খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে যে পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন তা ব্যবসায়ীবান্ধব হলেও, ব্যাংকবান্ধব বা অর্থনীতিবান্ধব ছিল না। এ নিয়ে সে সময় ৬৮ বিধিতে নোটিশ দিলেও স্পিকার তা আলোচনায় দেননি।
মেনন বলেন, গতকালই রিপোর্ট বেরিয়েছে বাংলাদেশ ঋণখেলাপিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষে, ১১.৪ শতাংশই খেলাপি ঋণ। গত দশ বছরে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা দিয়ে অর্থমন্ত্রীর আগামী বছরের বাজেট হতো।
নিউইয়র্কেও গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির গবেষণা মতে, ২০১৪ সালে এক বছরেই এই অর্থ পাচারের পরিমাণ ৯ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ৭২ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ। এই অর্থ পাচারকারীরা কানাডা, মালয়েশিয়া, ব্যাংককে বেগমপাড়া বানিয়েছে। কানাডা প্রবাসীরা এদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। তালিকা প্রকাশ করতে বলেছে। আমিও বলি সংসদে ঋণ খেলাপিদের মতো এই অর্থ পাচারকারী-বেগমপাড়ার মালিকদের নাম প্রকাশ করা হোক। ব্যাংক নিয়ে একটা সমাধানে আসতে ব্যাংক কমিশন গঠন করা হোক। একই পরিবারের ৯ জন ব্যাংক পরিচালক হওয়ার যে বিধান ব্যাংক মালিকদের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে যে আইন হয়েছে তা রদ করা হোক। সর্বোপরি ব্যাংক লুটেরাদের অর্থ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক।
পাঠকের মতামত: