সারোয়ার আহমদ :: ক্রমাগত ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকায় অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি খাত। একসময়ে পোশাক শিল্পের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এই চিংড়ি রপ্তানি খাতটি বর্তমানে নেমে এসেছে সপ্তম স্থানে। এছাড়া গত আট বছরে এ খাতের রপ্তানি আয় কমেছে ৪০ শতাংশ। এছাড়া গত সাত বছরে হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি কমেছে ১৭,৫৯৯ মেট্রিক টন এবং রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ২১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের গলদা ও বাগদার উৎপাদনশীলতা পৃথিবীতে সবচাইতে নিম্নবিত্ত। যা হেক্টর প্রতি মাত্র ৩শ-৪শ কেজি। ফলে এর উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। অন্যদিকে কম উৎপাদন খরচে উচ্চ ফলনশীল সস্তা ও সহজলভ্য সুস্বাদু চিংড়ি ভেনামি বিশ্ববাজার দখল করে নিয়েছে। মূলত এই দুই কারণে ক্রমাগত কমছে দেশের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি। এ সুযোগে বিশ্ব বাজার দখল করে নিয়ে ভালভাবেই চিংড়ি রপ্তানি করছে অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলো।
বর্তমানে দেশের ১০৫টি হিমায়িত খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী কারখানার বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৪ লক্ষ মেট্রিক টন। কাঁচামালের স্বল্পতার কারণে কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১০-১৫ শতাংশে। যা কারখানা বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনুকূল নয়।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র তথ্য অনুযায়ী সদ্য বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে চিংড়ি রপ্তানি হয় ৩২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। অথচ এর আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ৩৩৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থবছর শেষ এবারও ১ দশমিক ২০ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় চিংড়ি রপ্তানি খাতে। ক্রমাগত ঋণাত্বক প্রবৃদ্ধি চিত্রে দেখা যায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১ দশমিক ২০, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ, ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ, ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় থাকে।
এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশে চিংড়ি খাতে ভেনামিকে বাদ দিয়ে গলদা ও বাগদা প্রজাতির চিংড়িতেই মনোনিবেশ করা হচ্ছে। বর্তমানে এশিয়ার চিংড়ি উৎপাদনকারী ১৫টি দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া অন্য সকল দেশ ভেনামি চিংড়ি চাষ ও রপ্তানিতে নিয়োজিত। বাংলাদেশে বাগদা চিংড়ির উৎপাদন হেক্টর প্রতি ৩৪১ কেজি, যা ভারতে ৬০৪ কেজি। তারপরও বিগত ১০ বছর ভারত ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি চাষের মাধ্যমে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা হেক্টর প্রতি ৭ হাজার ১০২ কেজিতে উন্নীত করেছে। শুধুমাত্র ভারতই নয়, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশ তাদের উৎপাদন ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে।
দেশের হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানি খাতের সংকট থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সেক্রেটারি শেখ সোহেল পারভেজ বলেন, চিংড়ি খাতের ঋণাত্মক ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে আমাদের কিছু প্রস্তাবনা আছে। বৈশ্বিক বাজার ও চিংড়ির উদপাদন পরিমাণের উপর নির্ভর করে আমাদের কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। যার প্রধান সহায়ক হতে হবে সরকারকে।
তিনি বলেন, বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ বাগদা চিংড়ি সনাতনী পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে বিধায় হেক্টর প্রতি উৎপাদন মাত্র ৩শ-৪শ কেজি, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম। বর্তমানে চিংড়ি চাষের অধীন ২ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমির এক তৃতীয়াংশ জমিতেও ‘বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে’ সেমি ইনটেনসিভ পদ্ধতিতে চাষ করলে (প্রতি হেক্টরে ৩ হাজার কেজি) মোট উৎপাদন দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন, যা বিদ্যমান কারখানাগুলোতে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে অনায়াসে রপ্তানি করা সম্ভব। এছাড়া ভেনামি প্রজাতির চিংড়ি রোগ সহনীয়, অতি উচ্চ ফলনশীল (প্রতি হেক্টরে উৎপাদন ১০-১৫ মে. টন), উৎপাদন খরচ কম ও দামে সস্তা হওয়ায় ইতোমধ্যে বিশ্ববাজারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরু হয়নি।
অন্যন্য দেশের ভেনামি চিংড়ি চাষ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যে এশিয়ার চিংড়ি উৎপাদনকারী ১৫টি দেশের মধ্যে ১৪টি দেশ ভেনামি চিংড়ি চাষ শুরু করেছে। আমাদের পাশের প্রতিযোগী দেশসমূহ যেমন ভারত প্রতি বছর ৬ দশমিক ৫ লাখ মেট্রিক টন, ভিয়েতনাম ৪ লাখ, থাইল্যান্ড ৩ দশমিক ৫ লাখ ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি করছে। এ সকল দেশসমূহ পূর্বে বাংলাদেশের মতো বাগদা চিংড়ি উৎপাদনে নিয়োজিত ছিল। এখন বাগদার পাশাপাশি ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করছে। বিশ্ববাজারে ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন ও বাণিজ্যের পরিমাণ ৭৭%। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা এই বিপুল চাহিদা মেটাতে সক্ষম নয়।
পাঠকের মতামত: