ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

লাগামহীন হয়ে পড়ছে কক্সবাজারের ক্লিনিকগুলো

শাহীন মাহমুদ রাসেল :: দিন যত যাচ্ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গাসহ বাড়ছে কক্সবাজারের জনসংখ্যা। এ মানুষকে স্বাস্থ্য খাতে সরকারী সেবা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় দিনে দিনে লাগামহীন ভাবে বাড়ছে বে-সরকারী ক্লিনিকের সংখ্যা। এর মধ্যে অনেক ক্লিনিক উন্নত চিকিৎসা সেবার নিশ্চয়তা দিয়ে তৈরী করা হলেও তার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে তৈরী হচ্ছে মানহীন চিকিৎসা সেবা নামে প্রতারনার কেন্দ্র।

এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগই মানহীন। বিধি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চাহিদার ন্যূনতমও বিদ্যমান নেই এসব প্রতিষ্ঠানে। শুধু তাই নয়, সরকারি হাসপাতাল থেকে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের যে নিয়ম রয়েছে, তার কোনো তোয়াক্কা না করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের সীমানাগড় সংলগ্ন এলাকাতেই গড়ে তোলা হয়েছে এসব বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার।

স্থানীয় প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় আশেপাশের উপজেলায়ও সরকারি নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে দিনে দিনে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে অর্ধ শতাধিক ক্লিনিক। আর অতি মুনাফা লোভী ক্লিনিকগুলোর মালিকরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না রেখে সাধারণ ফার্মাস্টিস ও নার্স দিয়ে চলাচ্ছে এ ক্লিনিকগুলো। ফলে দিনে দিনে বাড়ছে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর ঘটনা। এসব মৃত্যুর ঘটনায় কোন বিচার না হওয়ায় ক্লিনিক মালিকগুলো দিনের পর দিন তাদের এ অপরাধ মুলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

জানা গেছে, গত কয়েক বছরের ব্যবধানে কক্সবাজারের ৮ উপজেলায় ছোট-বড় অর্ধ শতাধিকের মত বে-সরকারী ক্লিনিক ও হাসপাতাল হয়েছে। অধিক মুনাফা লাভের আশায় কয়েকজন ব্যক্তি সিন্ডিকেট করে এসব মানহীন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। এরমধ্যে রয়েছেন স্থানীয় ক্ষমতাশীল ব্যক্তি, ডাক্তার, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক নেতারা।

প্রতিটি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা হলেও এরমধ্যে সবচেয়ে বেশী হাসপাতাল গড়ে উঠেছে শহরের পৌর এলাকায়। এসব ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলোতে নেই বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। তবে সরকারি হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকগন পালা করে ক্লিনিকগুলোতে অস্থায়ীভাবে চেম্বার করে থাকে। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মাঝে কয়েকটিতে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি থাকলেও অধিকাংশ পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়ে চিকিৎসা এবং রোগ নির্ণয় কার্যকক্রম চালায় বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু গ্রামের ক্লিনিকগুলোতে নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও ডাক্তার। ফামাস্টিস নার্স ও ওয়ার্ড বয় দিয়ে চলে সেবা এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।

তারা তাদের ক্লিনিকগুলো চালানোর জন্য উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় দালাল নিয়োগ করেন। দালালরা বাড়ী বাড়ি গিয়ে রোগীদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়। এজন্য দালালরা হাসপাতাল মালিক ও ডাক্তারদের কাছ থেকে কমিশন পান বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আর ডাক্তারগুলো তাদের রোগীদের অপ্রয়োজনীয় টেস্ট বানিজ্যের মাধ্যমে বিভিন্ন হয়রানিসহ রোগীর ভেতর মানসিক অস্থিরতা সৃষ্টি করেন। এতে অর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন দরিদ্র ও মধ্যবিত্তরা।

বিশেষ করে গাইনী ডাক্তারগুলো সবচেয়ে বেশী হয়রানি করেন প্রসূতি মায়েদের এমন অভিযোগও শোনা যায়। তারা ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে এসে চমকপদ বিজ্ঞাপন ও দালালের মাধ্যমে তাদের প্রচার-প্রচারনা এমন ভাবে এলাকায় ছড়িয়ে দেন যেন সকল রোগের একমাত্র সমাধান তারাই দিতে পারেন। এভাবে রোগীদের ভোলবাল বুঝিয়ে টেষ্ট বানিজ্য শেষে সময়ের আগেই সিজার করতে বাধ্য করেন। এতে রোগীসহ নবজাত শিশু বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বলেও অনেকে দাবী করেছেন।

সুত্র জানায়, ওষুধ কোম্পানির এজেন্টদের সঙ্গেও সম্পর্ক থাকে। ওষুধের মান যাই হোক, ডাক্তার ভালো কমিশন পেলেই সেই ওষুধ রোগীর প্রেসক্রিপশনে স্থান পায়। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সঙ্গে বেসরকারি ক্লিনিকের সম্পর্ক বেশি। রোগীর আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাকে বেসরকারি ক্লিনিকে রেফার করা হয়। আর একবার বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি হলেই হল। গলাকাটা ফি, ডাক্তারের চড়া ফি, ওষুধের মূল্য নিয়ে রোগীর পকেট কাটা হয়। এসব হাসপাতালের চিকিৎসায় অনিয়মের তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রচার হলেও প্রতিকার হতে দেখা যায় না। এসব অনৈতিক ব্যবসার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা নেয়া হয় না।

জানা গেছে , গত কয়েক বছরের ব্যবধানে শহরের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালসহ বিভিন্ন উপজেলার ক্লিনিকগুলোতে একাধিক প্রসূতি ও শিশু কিশোর ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন। যার অধিকাংশই প্রতিবেদন হয়ে গণমধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ঘটনায় থানায় অভিযোগ হলেও উচ্চ পর্যায়ের তদবিরে রফাদফা হয়ে যায়।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের ডাক্তার আয়ুব আলী নামের এক অর্থোপেডিক্স সার্জন দীর্ঘদিন ধরে শহরের ডিজিটাল হাসপাতালসহ একাধিক ক্লিনিকে বসে রোগী দেখেন। তার হাতে ওই হাসপাতালে সেবা নিতে আসা এক কিশোর মারা যান।

গত বছরের ৯ নভেম্বর টমটমের চাকায় পিষ্ট হয়ে রামুর জোয়ারিয়ানালার মৌলভী পাড়ার মোহাম্মদ হোছনের ছেলে মোঃ রাসেল (২২) এর পায়ের তিন আঙ্গুলের হাঁড় আলাদা হয়ে যায়। তার আঙ্গুলের হাঁড়ের সার্জারি করার জন্য শহরের ডিজিটাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেদিন বিকেলে অপারেশনের জন্য রাসেলকে ওটিতে আনা হয়। পরে ডা: আয়ুব আলী ও ডা: আলাপন চাকমা অপারেশনের আগে রাসেলকে অ্যানেসথেসিয়ার ইনজেকশন দেয়। ইনজেকশন দেয়ার সাথে সাথে রাসেল প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে খিচুনি দিতে থাকে। পরে শারীরিক অবস্থা অবনতি হলে সদর হাসপাতালে আইসিউতে ভর্তি করার জন্য ডাক্তারেরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। সদর হাসপাতাল থেকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে রেফার করা হয়। সেখানে যাওয়ার পথে রাসেল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন রাসেল। সেদিন ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করেছেন তার পরিবার।

বছর খানেক আগে আল ফুয়াদ হাসপাতালে এক শিশুকে নিয়ে আসেন তার মা। সেখানে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নুরুল করিম খাঁন নামের এক ডাক্তার ওই শিশুকে সেবা দেন। শিশুটির পরিবার অভিযোগ করেন, শিশুটিকে অতিমাত্রায় এন্ডিবায়োটিক দেয়ার ফলে রাতের বেলা শিশুটি মারা যায় বলে পরিবারের অভিযোগ রয়েছে।

এর আগে কক্সবাজারের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অধ্যাপক আসাদুজ্জামানের ভুল চিকিৎসার কারণে শায়লা পারভীন শাকি নামে এক গৃহবধূর অকাল মৃত্যু হয়েছে বলে সেদিন অভিযোগ করেছিলো নিহতের পরিবার।

ওই গৃহবধূর স্বামী কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়াছড়ার আনোয়ার হোসেন মহিন সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক আসাদুজ্জামানের ভুল চিকিৎসা ও অবহেলার কারণে সন্তান প্রসবের পর তার স্ত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করেছিলেন।

সেদিন সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, তার স্ত্রীর প্রসব বেদনা উঠলে ডাক্তার খন্দকার আসাদুজ্জামানের কাছে নিয়ে যান। ওই ডাক্তার রোগীকে সরকারি হাসপাতালে যেতে নিষেধ করে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করতে বলেন। এরপর সাধারণ ডেলিভারির চেষ্টা না করেই তিনি রোগীকে অপারেশন করেন। অপারেশনের পর বাচ্চা প্রসব হয়। তবে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে প্রসূতি মুমূর্ষু হয়ে পড়লেও ডাক্তার যথাযথ চিকিৎসা দিতে অবহেলা করেন।

এর কিছুদিন পরে নিলুফা ইয়াছমিন পারভিন নামে প্রতিবন্ধী অন্তঃসত্ত্বা এক নারী গত কয়েকবছর আগে ডাক্তার খন্দকার আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে অমানবিক আচরণের অভিযোগ করেন। সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগে ওই নারী জানান, ডাক্তারের পছন্দের ক্লিনিকে আল্ট্রাসনোগ্রাফি না করায় তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করেন এবং তার দিকে ফাইল ছুড়ে মারেন।

সচেতন মহল অভিযোগ করেন, প্রশাসনের তদারকি না থাকায় একের পর এক ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হওয়ার পর ক্লিনিক মালিকগুলো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দাপটের সঙ্গে তাদের কার্যক্রম চালাতে দেখা যায়। তবে এত অভিযোগ থাকা সত্বেও নিরুপায় হয়ে এসব ক্লিনিক ও হাসপাতালে পুনরায় চিকিৎসা নেন নানা রোগে আক্রান্ত সেবা প্রত্যাশীরা।

এইসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহমুবুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, এইসব অভিযোগ আগে কখনো শুনিনি। ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর খবর বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, কক্সবাজারে গণমাধ্যম কর্মী বলে কেউ নেই! কারণ জার্নালিজম নিয়ে পড়াশোনা করা ব্যাক্তিদেরকেই গণমাধ্যম কর্মী বলে মনে করি। একপর্যায়ে তিনি আরোও বলেন, এখন করোনাকাল, ফ্রন্ট লাইনে থেকে যারা সেবা দিয়ে যাচ্ছে, আপনারা তাদের বিরুদ্ধে লেগেছেন।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমান বলেন, কিছু কিছু ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। এ ব্যাপারে প্রশাসনের নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। শিগগরই প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

পাঠকের মতামত: