ঢাকা,শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

ডোবা নালায় পরিণত হচ্ছে রামু-সদরের কৃষি জমি, লুট হয়ে যাচ্ছে উর্বর মাটি

শাহীন মাহমুদ রাসেল :: প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুম এলেই এক্সাভেটর (খননযন্ত্র) মেশিন বসিয়ে শত শত বিঘা জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। ভাটা মালিকদের অর্থের লোভে কৃষকরা মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে জমিগুলো উর্বরতা হারাচ্ছে। আর জমিগুলো অনাবাদি হয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনা ঘটছে কক্সবাজার সদর ও রামু উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। কৃষকরা বলছেন, প্রশাসন জানলেও কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ভাটা মালিকদের দাবি, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে কাজ।

জানা যায়, কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের হিসাব অনুযায়ী সদর এবং রামুতে কয়েক বছর আগে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল চাষাবাদ করা হতো। আর বর্তমানে কৃষি জমির পরিমাণ ১২ হাজার হেক্টরে নেমে এসেছে। বর্তমানে আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে সবজি, সাড়ে আট হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান এবং আড়াইশ হেক্টর জমিতে অন্যান্য সবজি চাষাবাদ করা হচ্ছে। রামু ও সদরে অর্ধশত ইটাভাটা রয়েছে। আমনের মৌসুম শেষে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি চলে যাচ্ছে ইটভাটায়। এতে করে কক্সবাজারের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা ধরতে রাখতে বেগ পেতে হবে কৃষি বিভাগকে।

উপজেলায় আগে ৪২ হাজার কৃষি পরিবার থাকলেও আবাদী জমি কমতে থাকায় কৃষক পরিবারের সংখ্যাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। মাটিখেকোরা কৃষি জমির মাটি গভীর করে কেটে নেয়ায় ফসলি জমি হারাচ্ছে কৃষক। বিপর্যয় ঘটছে পরিবেশের। আর ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ায় কৃষকদের পরিবারে অভাব অনটন ও হতাশা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে রামুতে বেশি ইটভাটা থাকায় সেসব জায়গায় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে অধিক পরিমাণ ফসলি জমির উর্বর মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে।

এদিকে মাটি বহনকারী ট্রাক্টর চলতে গিয়ে গ্রামীণ সড়কগুলোর বেহাল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন শত শত মাটিভর্তি ট্রাক্টর চলাচল করায় মাটির রাস্তা নষ্ট হচ্ছে। ধুলার কারণে রাস্তায় চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে সাধারণ মানুষের।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে রামু ও সদরের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ইটভাটা মালিকরা স্বল্পমূল্যে চুক্তির ভিত্তিতে আমন ধান কাটার পর পড়ে থাকা জমিগুলো ২ থেকে ৩ ফুট গভীর করে কেটে মাটি নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটায়। সেই মাটি ব্যবহার করে বানানো হচ্ছে ইট। জমির উপরিভাগ অর্থাৎ উর্বর অংশ কেটে নিয়ে যাওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা কমে যাচ্ছে জমির। এতে করে ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শ্রীমুরা গ্রামের দিনমজুর কবির আহাম্মদ বলেন, এই জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তার পাশে ভাটায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ট্রিপ অনুযায়ী আমাদের ভাড়া দেওয়া হয়। যত বেশি মাটি ভাটায় দেওয়া হয় তত টাকা পাই। আমরা ১২ জন মাটি কেটে ট্রাক্টরে করে দিনে ১৫-২০ ট্রাক্টর মাটি ভাটায় দিতে পারি।

একই এলাকার রেজাউল জানান, ভাটা মালিকরা কৃষকদের সঙ্গে চুক্তি করেন মাটি ভাটায় নেওয়ার জন্য। আমরা ২০-২৫ দিন ধরে মাটি কাটছি। ইতিমধ্যে ৩টি জমির প্রায় ৪-৫ বিঘা মাটি কেটে নেওয়া হয়েছে।

পিএমখালী চেরাংঘর গ্রামের মাটি ব্যবসায়ী কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, আমাদের মতো ব্যবসায়ী ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় বিক্রি করছে। গভীর করে মাটি কেটে নেওয়ায় পাশের জমির মালিকের ক্ষতির কথাও স্বীকার করেন তারা।

একই গ্রামের কৃষক ছুরুত আলম জানান, বেশি টাকা পাওয়ার কারণে তার দুই বিঘা ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে দিয়েছেন। পরে ওই জমিতে আগের মতো আর ফসল হবে কিনা তা তিনি জানেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রামুর এক ভাটা মালিক জানান, প্রত্যেক ইটভাটায় এক মৌসুমে কম হলেও ১০ একর জমির মাটি ব্যবহার হয়। সে হিসাবে প্রতি বছর কমপক্ষে ২ হাজার একর জমির মাটি শুধু ইটভাটায় চলে যাচ্ছে। কোনো কোনো জমি থেকে পরপর কয়েক বছর মাটি নেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ জমি থেকে শুধু উপরিভাগের মাটি নেওয়া হচ্ছে। কারণ উপরিভাগের মাটি দিয়ে তৈরি ইটের গুণগত মান ভালো হয়।

সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা গোলাম সরওয়ার তুষার জানান, সরকারি নিয়ম না মেনেই ফসলি জমিতে অনেক ইটভাটা তৈরি হয়েছে। আর এসব ভাটার জন্য মাটির প্রয়োজন। তাই উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের জমির টপ সয়েল তারা নিচ্ছে। এতে ফসলি জমি ও কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। আর এ টপ সয়েল কেটে নেওয়া বন্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই।

কক্সবাজারের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আবুল কাশেম জানান, উপরিভাগের মাটি বা টপ সয়েল একটি জমির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাটির ৬ ইঞ্চি গভীরতাতেই ফসলের সব ধরনের খাবার থাকে। যে আবাদি জমির উপরিভাগের মাটি ইটভাটায় বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে সেসব জমির চাষাবাদ অন্য জমির মতো হবে না। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি, জমির উপরিভাগের মাটি নষ্ট না করতে।

এ প্রসঙ্গে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা বলেন, ফসলি জমির মাটি কেটে নেওয়ার কথা মৌখিকভাবে শুনেছেন। খোঁজ নিয়ে মাটি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরাইয়া আক্তার সুইটি, ফসলি জমি খেকে মাটি কেটে ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া এটা একটা অপরাধ, দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযান চালানো হবে।

পাঠকের মতামত: