ঢাকা,রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

চকরিয়ায় ঠেকানো যাচ্ছে না বদরখালীর প্যারাবন নিধনযজ্ঞ

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
আওয়ামীলীগ সরকারের প্রভাব খাটিয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক পরিবেশ বিধ্বংসী ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব ঘটনায় দখলদারদের ঠেকাতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা। এরই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকূলীয় জনপদ বদরখালীতে বেসরকারি সংস্থা (উবিনীগ) কর্তৃক সৃজিত প্যারাবনের গাছ নিধন করে চিংড়ি ঘের তৈরির পাঁয়তারা করছিল স্থানীয় দখলবাজ চক্র।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) বদরখালীতে প্যারাবন নিধনের অভিযোগ এনে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর ৩০ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছিল। এছাড়াও দায়েরকৃত মামলায় অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করা হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো. আবদুছ ছালাম বাদী হয়ে চকরিয়া থানায় এই মামলাটি দায়ের করেন। এতে প্রকৃত ঘটনার সাথে জড়িতদের নাম বাদ দিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত বেশকিছু দলীয় নেতা-কর্মী ও স্থানীয় নিরীহ ব্যক্তিদের নামে মামলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যাদের মধ্যে কেউ লবণচাষী, কৃষক, নৈশপ্রহরী ও দোকানের কর্মচারী বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী আবদুল কাদের।

 

বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বদরখালী ইউনিয়নের যেসব জমি রয়েছে তার পুরোটাই কৃষি ও উপনিবেশ সমিতির আওতাধীন। উল্লেখ্য, এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম সমবায় সমিতি হিসেবে এই সমিতির সুপরিচিত ও খ্যাতি রয়েছে। বদরখালী সমিতির পক্ষ থেকে ৯টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়। লটারির মাধ্যমে প্রতিটি ওয়ার্ডকে একটি করে মাছের ঘের বরাদ্দ দেওয়া হয়। বদরখালী-মহেশখালী সেতুসংলগ্ন দক্ষিণ পাশের মাছের ঘেরটি ছনুয়াপাড়া লটারি ঘের নামে পরিচিত। এই ঘেরের অংশীদার ২৯ জন। ছনুয়াপাড়া লটারির লোকজনই উবিনীগের প্যারাবন কেটে চিংড়ি ঘের তৈরির মানসে শতাধিক ব্যক্তি প্যারাবন নিধন করার বিষয়টি বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ ও গণমাধ্যমে  ছড়িয়ে পড়লে চকরিয়া উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিধন ঠেকিয়ে দেন। পরে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা দায়ের করেন।
জানা গেছে, গত ১৪ জানুয়ারি দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে চকরিয়ায় ‘প্যারাবন নিধন করে চিংড়ি ঘের তৈরি’র সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরপর ১৭ জানুয়ারি চকরিয়া উপজেলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাহিদ হোসাইন একটি মামলা দায়ের করেন। ঘটনার সত্যতা যাচাই করে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার পরিচালককে ৩০ দিনের মধ্যে আদালত প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেন।
পরে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর ঘটনায় জড়িত ও সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ এনে প্রকৃত জড়িতদের এবং অপরাধীদের বাদ দিয়ে নিরীহ ১৩ জনের নামে প্রতিবেদন দাখিল করেন আদালতে। এনিয়ে স্থানীয় ভূক্তভোগীরা অভিযোগ তুলে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে।

 

 

পরে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক আরো একটি মামলা করেন। এই মামলায় আদালত আমলে নিয়ে ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশ দেন। আদালত কর্তৃক নির্দেশনার প্রায় আট মাস পরে বদরখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও উবিনীগের কর্মকর্তা জয়নাল আবেদিন খান এবং পরিবেশের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী সিরাজুল হক।
তিনি আরও জানান, সেই প্রতিবেদনে প্রকৃত ঘটনায় জড়িতদের নাম বাদ দিয়ে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকা এলাকার বেশকিছু নিরীহ ও স্থানীয় বিএনপি রাজনৈতিক নেতাদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতির দু’বারের সাবেক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী চৌধুরীকেও উদ্দ্যেশ্যমূলক আসামি করা হয়েছে। এনিয়ে এলাকায় সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
স্থানীয় বিএনপির নেতাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে বেশ কয়েকজন নেতা জানান, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিকভাবে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে এ হয়রানিমূলক মামলাটি করা হয়। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ওইসব মামলা প্রত্যাহার করলেও বদরখালী ইউনিয়নে প্যারাবন নিধনের উদ্দেশ্যে প্রণোদিত মামলায় জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদের অব্যাহতি দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবী জানিয়েছেন তারা।
বুধবার (৬ নভেম্বর) সকালে সরেজমিনে প্যারাবন পরিদর্শনে দেখা গেছে, মহেশখালী চ্যানেলের পূর্ব পাশে বদরখালী ব্রিজের দক্ষিণে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল আকারের প্যারাবন। ওই সময় প্যারাবনটি জোয়ারের পানিতে সয়লাবের দৃশ্যেরও দেখা মেলে। এক একটি গাছের উচ্চতা ২০ থেকে ২৫ ফুট। নেই কোনো ধরণের বাঁধ ও চিংড়ি ঘের। এই প্যারাবনে মহেশখালী চ্যানেল লাগোয়া গত ১৩ জানুয়ারি গাছ নিধনযজ্ঞে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়েরকৃত মামলায় এলাকার বেশকিছু নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়। এনিয়ে এলাকার মানুষের মাঝে বিরাজ করছে চাপা ক্ষোভ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, মূলত বদরখালী সমিতির আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিছু স্বৈরাচার আওয়ামী লীগের দোসররা প্রতিপক্ষ হিসেবে ঘায়েল করতে ও নির্বাচনের প্রার্থী থেকে দূরে সরাতে পরিকল্পিতভাবে পরিবেশের মামলায় আসামি করা হয়েছে বলে দাবী করেছেন। এছাড়াও উবিনীগ সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়েরকৃত মামলা নিয়ে বদরখালীতে আসামিদের বিভিন্ন হয়রানি ও মামলা-বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছে স্থানীয়রা।

 

বদরখালী সমবায় কৃষি ও উপনিবেশ সমিতির সম্পাদক মো. মঈন উদ্দিনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্যারাবন নিধনের ঘটনা নিয়ে জড়িত নয় এমন ব্যক্তিদের আসামি করার বিষয়টি অসত্য নয়। এই প্যারাবন রক্ষায় সকলেই আন্তরিক। প্রশাসনের হস্তক্ষেপের কারণে যেভাবে প্যারাবন উজাড় করে চিংড়ি ঘের তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেভাবে প্যারাবনের গাছ কাটা ও বাঁধ দিয়ে চিংড়িঘের তৈরি করা সম্ভব হয়নি।

 

 

মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী বলেন, প্যারাবন নিধনের ঘটনার সাথে আমার সম্পৃক্ততা না থাকার পরও এলাকায় রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে পরিবেশে অধিদপ্তরকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্যে প্রণোদিত আসামি করা হয়েছে। তাছাড়া আমার মতো এলাকার আরো বহু নিরীহ লোকজনকে এই মামলায় আসামি করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে উবিনীগের কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন খান বলেন, ঘটনার সাথে যাদের সম্পৃক্ত রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। তবে নিরীহ ব্যক্তিদের ব্যাপারে আদালতে উবিনীগের পক্ষ থেকে নারাজি আবেদন করে পুণরায় তদন্ত চাওয়া হবে।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন,  তদন্তকারী কর্মকর্তা সম্প্রতি অন্য জায়গায় বদলি হয়েছেন। তদন্তে নিরীহ কাউকে জড়ানো হলে আমার করার কিছু নেই। তবে আদালত পুনরায় তদন্তের আদেশ দিলে সেক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

পাঠকের মতামত: