বি,এম হাবিব উল্লাহ, পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিনিধি :::
-পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকা গুলোতে তামাক চাষ আশংকাজনক হারে বেড়ে গেছে। তামাক কোম্পানির কাছ থেকে অগ্রিম ঋণ পাওয়ার লোভে বান্দরবানের আলীকদম-লামা উপজেলায় দিন দিন বাড়ছে তামাকের চাষ। বিনা মূল্যে বীজ, ঋণে সার ও নগদ অর্থ দেয়ার পাশাপাশি তামাক কেনার নিশ্চয়তা পেয়ে তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছে এ অঞ্চলের চাষিরা। এক সময় ধান, ভুট্টা, আলু, বেগুন, লাউ, শিম, মূলা ও ফুলকপি/বাঁধাকপিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষের জন্য সুনাম ছিল এ উপজেলার। কিন্তু মাঠের পর মাঠ এখন চোখে পড়ে শুধু তামাকের ক্ষেত। যতো দিন যাচ্ছে, ততোই বাড়ছে তামাক চাষ। কৃষিবিভাগ তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করলেও বিভিন্ন কোম্পানির লোভনীয় আশ্বাসে তামাক চাষের দিকেই ঝুঁকে পড়ছেন এ উপজেলার চাষীরা। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গোটা বিশ্বের সঙ্গে দেশবাসী যখন সরব, তখন গাছগাছালির সবুজ বনায়নের বদলে উপজেলায় তামাক চাষের প্রসার নিয়ে সচেতন মহল উদ্বিগ্ন। এখনিই পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষ বন্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা না হলে আবাদি জমির উর্বরতা হ্রাস পেয়ে অচিরেই উপজেলায় খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিগত বছরগুলোতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সরকারী জমিতে তামাক চাষ নির্মূল অভিযান পরিচালনা করা হলেও গত দুই-তিন বছর ধরে তা হচ্ছে না। ফলে দিন দিন তামাক চাষ বেড়ে চলেছে। আবার উৎপাদিত তামাক প্রক্রিয়াজাত করতে বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয়েছে দুই সহস্রাধিক তন্দুর (চুল্লি)। এসব চুল্লিতে জ্বালানি হিসেবে পোড়ানো হয়ছ সংরক্ষিত ও প্রাকৃতিক বনের কাঠ। স্থানীয় এক শ্রেণীর বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণে লাখ লাখ মণ কাঠ ব্যবহার করা হয়। ফলে দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে এখানকার বনাঞ্চলসমূহ। আর বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে পরিবেশ। লামা উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে লামা উপজেলায় তামাক চাষ হয়েছিল ৯৮০ হেক্টর জমিতে। চলতি বছর সাড়ে আটশ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। তবে কৃষি অধিদপ্তরের দেওয়া এ তথ্য মানতে নারাজ স্থানীয় কৃষকরা। তাদের দাবি, চলতি বছর এ জেলায় দ্বিগুণ বেশি জমিতে চাষ হয়েছে বিষবৃক্ষ তামাক। কৃষকরা জানিয়েছেন, ফসল চাষের শুরুতে কৃষকরা অর্থ সংকটে ভোগেন। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে তামাক কোম্পানিগুলো চাষিদের মধ্যে কার্ড দিয়ে বিনামূল্যে বীজ সরবরাহ করে। সেই সঙ্গে কোনো শর্ত ছাড়াই ঋণে সার ও নগদ অর্থ দেয়। এরপর প্রতিটি কোম্পানির নিজস্ব সুপারভাইজাররা প্রতিনিয়ত চাষিদের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেয়। তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের উৎপাদিত তামাক কেনার শতভাগ নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এসব লোভনীয় আশ্বাসে তামাক চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। তামাকের আগ্রাসন থেকে মাঠঘাট, ফসলি জমি, বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জমি, মাতামুহুরী নদীর চর ও দু’পাড়সহ কোন কিছুই বাদ যায়নি। সর্বন্থরেই হয়েছে তামাক চাষ। তামাক চাষ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও অধিক মুনাফার আশায় নারীসহ পরিবারের সবাই সমানভাবে কাজ করছে তামাক ক্ষেতে। এ কাজে অংশ নিচ্ছে শিশুরাও। লামা পৌরসভা এলাকার ছাগলখাইয়া গ্রামের চাষি আমান উল্লাহ জানায়, তামাক চাষের জন্য কোম্পানিগুলো অগ্রিম ঋণ হিসেবে সার ও নগদ টাকা দিচ্ছে। উৎপাদিত তামাক তারাই কিনে নেয় বলে বিক্রি নিয়ে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। এমন নিশ্চয়তা অন্য কোনো ফসল চাষের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। তাই তারা তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছে। তবে সরকার যদি কোম্পানির মতো বিনা শর্তে ঋণসহ ফসল কেনার নিশ্চয়তা দেয় তাহলে তারা তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্যান্য ফসল চাষ করবে। এজন্য সরকারের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করেন তারা। স্কুলের ফাঁকে বাবা-মায়ের সঙ্গে তামাক ক্ষেতে কাজ করে ছাগলখাইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী বিলকিছ আক্তার। তার ভাষায়, প্রতিবছর তামাক বিক্রির টাকায় নতুন পোশাক কিনে দেয় বাবা-মা। তাই তামাক পাতার গন্ধ ভালো না লাগলেও তামাক ক্ষেতে কাজ করি। রুপসীপাড়া ইউনিয়নের দরদরী গগণমাস্টার পাড়ার চাষী শাহ্ আলম জানায়, সবজি চাষে খরচের তুলনায় মুনাফা কম। কিন্তু তামাক চাষে মুনাফা বেশি। আবার কোম্পানির টাকায় চাষাবাদ করা যায়। তাই দিন দিন তামাক চাষির সংখ্যা বাড়ছে। চাষিদের সুবিধার জন্য কোম্পানিগুলো লামা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছেন বড় বড় ক্রয়কেন্দ্র ও গোডাউন। যেখানে চলে যায় কৃষকদের উৎপাদিত তামাক। ব্রিটিশ আমলের নীলকর জমিদারদের মতোই উপজেলায় এ বিষের আবাদ করার জন্য আস্তানা করেছে ঢাকা টোবাকো, আবুল খায়ের টোবাকো, নাসির টোবাকো, আকিজ টোবাকো ও বৃটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ তামাক কোম্পানি। চাষিদের যাবতীয় সমস্যার ব্যাপারে সর্বদাই সজাগ থাকছে এসব তামাক কোম্পানি সুপারভাইজার ও কর্মকর্তারা। এদিক থেকে পিছিয়ে পড়ছেন সরকারের কৃষি বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। লামা সদর ইউনিয়নের মেরাখোলা গ্রামের তামাক চাষি নজির আহমদ, হবিবুর রহমান ও আবু বকর জানায়, তামাক কোম্পানির কর্মীরা প্রতিদিন মাঠে গিয়ে তামাক চাষিদের সঙ্গে দেখা করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করে থাকে। অন্যদিকে, সবজি ক্ষেত নষ্ট হলেও বেশিরভাগ সময় সরকারি কৃষি কার্যালয়ের লোকজনের দেখাও পাওয়া যায় না। তাই তারা সবজি চাষ না করে তামাকের চাষ করেছেন। সরেজমিন তামাক ক্ষেতে কথা হয়, লামা পৌরসভার এলাকার ছাগল খাইয়া গ্রামের কৃষাণী আয়েশা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, দিনভর তামাক ক্ষেতে কাজ করে পাই মাত্র দেড়শ টাকা। বিকল্প কোন কর্মসংস্থান না থাকায় অল্প বেতনে তামাক ক্ষেতেই কাজ করতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তামাক পরিচর্যা করার সময় মাঝে মধ্যে পাতার বিষাক্ত গ্যাসে বমি বমি ভাব হয়, মাথা ঘুরায়, শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়। তামাকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলনে নিয়োজিত বেসরকারী সংস্থা উবিনীগ’র কক্সবাজারের আঞ্চলিক সমন্বয়ক রফিকুল হক টিটো বলেছেন, তামাক চাষের কারণে পরিবেশ বিপর্যয়ের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সবচেয়ে ক্ষতির শিকার হচ্ছে খাদ্য ফসলের আবাদি জমি। কারণ তামাক চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির অণুজীব নষ্ট হচ্ছে এবং জমি হারাচ্ছে উর্বরতা শক্তি। ফলে ওই জমিতে শত চেষ্টা করলেও অন্য কোন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। লামা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শফিউর রহমান মজুমদার জানিয়েছেন, তামাক শোধনের সময় নির্গত নিকোটিনের কারণে এলাকার লোকজন হাঁপানি, কাশি এবং ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। লামা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূরে আলম বলেন, তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগ যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু চাষিরা অধিক মুনাফার আশায় তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছে। তবে কৃষকদেরকে তামাক চাষ থেকে ফেরাতে চলতি মৌসুমে বিকল্প সরিষা, ভুট্টা ও গম আবাদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি চাষ দেয়া হয়েছে।
পাঠকের মতামত: