অবৈধ পথে আসা বিদেশী চোরাই সিগারেটে জমজমাট এখন চট্টগ্রামের বাজার। আর এসব চোরাই সিগারেটে পাইকারি রমরমা বানিজ্যে চলছে। সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে এসব অবৈধ সিগারেটের কোটি টাকার ব্যবসা হলেও স্থানীয় প্রশাসন যেন নির্বিকার। বেশ কিছুদিন আগে লোক দেখানো অভিযান চালালেও অধরায় রয়ে গেছে মূল হোতারা । এতে করে প্রতিমাসে কোটি টাকার ও বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
অবৈধ পথে আসা এসব সিগারেটের মূল ঘাটি নগরীর রিয়াজুদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ ও মাদুনাঘাটে। এসব বাজার ছাড়াও আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাসা নিয়ে একটি সিন্ডিকেট প্রতিদিন নগরীর বিভিন্ন দোকানে মাঠ কর্মীদের দিয়ে সিগারেট বিক্রি করছে। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসব ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে একটি বিশাল সিন্ডিকেট। এসব অবৈধ সিগারেটের পেছনে উর্দ্বতন কর্মকর্তাদের হাত রয়েছে। তাদের ম্যানেজ করে অনাশয়ে ঢুকে যাচ্ছে নগরীতে। অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
সূত্রে জানায়, সংঘবদ্ধ চোরাকারবারীরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে অতি কমদামে তা হাট-বাজারে বিক্রি করছে। অভিযানের নামে লোক দেখানো অভিযান চালালেও ফলদায়ক তেমন কিছু লক্ষ্য করা যায়নি। মাদকদ্রব্য থেকে দূরে থাকুন নামে বেনামে মানববন্দনসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালিয়ে মিডিয়ার শিরোনাম হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। চাহিদা অনুযায়ি এসব বিদেশী সিগারেট নিয়মিত ধূমপায়ীদের তুলনায় উঠতি বয়সী তরুণ ক্রেতারাই বেশি কিনে থাকে। ফলে যুব সমাজের একটি বিশাল জনগোষ্টি দিন দিন ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।
শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সব সিগারেটের প্যাকেটে ‘ছবিযুক্ত সংবিধিবদ্ধ সতর্কতা’ এবং ‘রাজস্ব স্ট্যাম্প’ ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা থাকলে অবৈধ এসব সিগারেটের প্যাকেটে কিছুই লেখা থাকে না। মেয়াদোত্তির্ণের তারিখও নেই এসব সিগারেটে। ধুমপায়ীরাও এসব বিষয়ে তেমন একটা সর্তকতা অবলম্বন করেনা।
চোরাই সিগারেটের ওপর বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত এক বাজার জরিপে দেখা গেছে, বিদেশী সিগারেট আমদানিতে ৩৫০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। দেশে প্রতি বছর প্রায় ৭ কোটি ২০ লাখ বিদেশ থেকে আগত চোরাই সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। সরকার এসব সিগারেট থেকে আমদানি শুল্ক আদায় করতে পারলে বছরে আরো প্রায় ১১০ কোটি টাকার মতো রাজস্ব পেত।
সরেজমিনে দেখা যায়, রিয়াজ উদ্দিন বাজারে ৩০ থেকে ৪০টি দোকনে প্রকাশ্যেই এসব সিগারেট বেচাকেনা চলছে। প্রতিটি দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিদেশী সিগারেট বেচাকেনা হয়। নগরীর তিনটি পাইকারি বাজারে প্রতিদিন প্রায় ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকার অবৈধ সিগারেট কেনাবেচা হয়। সে হিসাবে মাসে প্রায় ৮ কোটি’র অধিক টাকার অবৈধ সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। তা বছরে দাড়ায় ১০০ কোটি টাকা। নগরীর এ ৩টি বাজার থেকে ঢাকাসহ সারা দেশে এসব সিগারেটের বিপণন হয়ে থাকে। ঢাকার কিছু কিছু স্থানে পাইকারি হারে এসব সিগারেট বিক্রি হলেও চট্টগ্রামই মূল ঘাঁটি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এসব দোকানের কয়েকটির নাম লেখা থাকলেও একাধিক দোকানে নাম নেই। কিন্তু সারিবদ্ধভাবে সাজানো আছে অর্ধশতাধিক ধরনের বিদেশী সিগারেট। সাজানো সিগারেটের মধ্যে রয়েছে- ইজি স্পেশাল গোল্ড, মন্ড, স্ট্রবেরি, ভন ইন্টারন্যাশনাল, উইনস্টোন, গ্রান্ড-২০০০, ইজি অউরা, ব্লাক, মালবোরো, উলসন ল্যান্ড এম, মডার্ন, ডাবল হ্যাপিনেস ও ডানহিলসহ বিভিন্ন নামের সিগারেট। ক্রেতা সেজে চোরাই সিগারেটের বিক্রি ও বিপণন নিয়ে জানতে চাইলে রিয়াজুদ্দিন বাজারের সিগারেট দোকানের এক কর্মচারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি জানান, অবৈধ উপায়ে সমুদ্র পথে এবং বিমানবন্দরের মাধ্যমে সিগারেটগুলো বেশি নিয়ে আসা হয়। বন্দরের কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে দোকানদাররা এই কাজটি করে থাকেন। এসব চোরাই সিগারেট কেনাবেচার নির্দিষ্ট কিছু লোক আছে। ফোন করে খবর দিলেই তারা এসে দোকানে দোকানে সিগারেট দিয়ে যায়। এখন খুচরা বিক্রেতাদের এসব সিগারেট কিনতে বা বেচতে কোন ঝক্কি পোহাতে হয় না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে উৎপাদিত প্রিমিয়াম সেগমেন্টের ২০ শলাকা সিগারেটের মূল্য ১৮২ টাকা। আবার উচ্চ সেগমেন্টের ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের দাম ১০৮ টাকা। এই দুই সেগমেন্টের ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতেই বিদেশ থেকে চোরাই পথে আনা এসব সিগারেটের ২০ শলাকার প্যাকেট বিক্রি করা হয় ১৪০-১৫০ টাকা। যেমন মন্ড স্ট্রবেরি, মন্ড আপেল এই ২০ শলাকার একটি প্যাকেট ক্রেতাদের কিনতে হয় মাত্র ৯০টাকা। যা দেশিয় প্রিমিয়াম সেগমেন্টের ২০ শলাকার সিগারেটের চাইতে অনেকগুণ কম। ফলে এসব সিগারেটের প্রতি ক্রেতার চাহিদাও বেশি।
কিন্তু আমদানি শুল্ক দিয়ে বৈধ পথে আনলে ২০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেট প্রায় তিনগুণ দামে বিক্রি হতো। চোরাকারবারিরা শক্তিশালী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, চীন ও দুবাই থেকে অবৈধ পথে এসব সিগারেট আনছে।
দেশী প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের সিগারেট বিক্রি করে খুচরা বিক্রেতারা যে পরিমাণ মুনাফা পায় বিদেশী এসব অবৈধ সিগারেট বিক্রি করলে তার চেয়ে ৫ প্রায় গুণ বেশি মুনাফা পায়। এসব সিগারেটে কর সংযুক্ত থাকে না বিধায় ক্রেতার জন্যও লাভজনক হয়।
এদিকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গত তিন বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বৈধভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইজি ও মন্ড ব্র্যান্ডের এক শলাকা সিগারেটও আমদানি হয়নি। অথচ খুচরা বাজারে এসব ব্র্যান্ডের সিগারেটের ছড়াছড়ি। একইভাবে আরও একটি বিদেশি ব্রান্ডের সিগারেট পাইনও এখন সহজলভ্য।
বন্দর ও বিমানবন্দরের মতো বৈধ পথ ব্যবহার করেই এসব অবৈধ সিগারেট আনছে চোরাকারবারিরা। এসব সিগারেট থেকে সরকার রাজস্বও পাচ্ছে না। গত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা অন্তত তিনটি বড় চালান জব্দ করেছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। কাস্টমসের হিসাবে, এই তিন চালানে থাকা সিগারেটের বাজারমূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা। এসব সিগারেট চোরাচালানের ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মূল চোরাকারবারিদের হদিস পাওয়া যায়নি। তাহলে এসব অবৈধ সিগারেট বাজারে কিভাবে আসছে এসব প্রশ্ন থেকেই যায় ?
সাথে কথা হলে, নাম জানাতে অনিশ্চুক দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, এতো নিরাপত্তা থাকা সত্ত্বেও কিভাবে এসব সিগারেট বাজারে আসছে তা বোধগম্য নয়। যা রিতিমতো অভাক হওয়ার বিষয়। তিনি বলেন, এসব সিগারেটের কারনে দিন দিন দেশীয় সিগারেটের উপর চাহিদা কমে যাচ্ছে। অবিলম্বে এ বিষয়ে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশীয় সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসানে পড়বে বলে জানান তিনি।
নগরীর চকবাজারের এক খুচরা বিক্রেতা জানান, দেশী সিগারেটের চাইতে বিদেশী ব্রান্ডের সিগারেটের উপর ক্রেতাদের চাহিদা বেশি। কিভাবে এসব সিগারেট আপনাদের হাতে আসে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্দিষ্ট কিছু লোক আছে। ফোন করলে তারা আমাদের দিয়ে যায়। তাছাড়া রিয়াজউদ্দিন বাজারে পাইকারি দোকানেও এসব সিগারেট পাওয়া যায়। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্রার্চায্য ( অপরাধ ও অভিযান) জানান, আমরা বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়েছি। আটকও করা হয়েছে কয়েকজনকে। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। এতো অভিযানের পরও কিভাবে অবৈধ সিগারেট বাজারে পাওয়া যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন থেকে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের ধরতে শিঘ্রই অভিযানে নামবে পুলিশ।
অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো, মুমিনুর রশিদের সাথে কথা হয়। তিনি এ প্রদিবেদককে জানান, আমরা এ বিষয়ে মনিটরিং করছি। আগামী সপ্তাহে থেকে এসব সিগারেটের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে ভ্রাম্যমান আদালত। নাম জানাতে অনিচ্ছুক শুল্ক গোয়েন্দা এক কর্মকর্তা জানান, বেশিরভাগ সিগারেট আইনের চোখকে ফাঁিক দিয়ে বন্দর দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। অনেকে উর্দ্বতন কর্মকার্তাদের সাথে চোরাকারবারিদের হাত রয়েছে।
পাঠকের মতামত: