ঢাকা,শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪

বীজ কোম্পানির প্রতারণা

চকরিয়ায়  ভেজাল ও নিন্মমানের বীজ রোপনে মরে যাচ্ছে অর্ধশতাধিক কৃষকের মরিচ খেত

চকরিয়া পুর্ববড় ভেওলা ইউনিয়নের কৃষকের জমিতে ভেজাল বীজ রোপনে মরে যাচ্ছে মরিচ ক্ষেত

এম.জিয়াবুল হক, চকরিয়া ::

চকরিয়া উপজেলার পুর্ববড় ভেওলা ইউনিয়নে সুপ্রীম সীড কোম্পানির সানড্রফ ও শহীদ এগ্রো সীড কোম্পানির ভেজাল মরিচ বীজ রোপন করে ইতোমধ্যে শতাধিক কৃষক হয়েছেন সর্বশান্ত। ফলন আসার শুরুতেই মরে যাচ্ছে ক্ষেতের বেশিরভাগ মরিচ গাছ।

নয়াচরের কৃষকদের এই ধরণের ফলন বিপর্যয়ে হতবাক আশপাশের কৃষকসহ সবস্তরের মানুষ। তাদের এই দুর্দিনে পাশে দাঁিড়য়েছেন পুর্ববড় ভেওলা ইউনিয়ন কৃষকলীগের সভাপতি কামরুজ্জামান সোহেল। তিনি বলেন, ভুক্তভোগী কৃষকরা ভেজাল বীজের কারণে ফলন বিপর্যর ও মরিচ ক্ষেত মরে যাওয়ার ঘটনাটি জানিয়েছেন। রোববার নয়াচর ব্লকে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা জনী নন্দীকে সাথে নিয়ে মরিচ ক্ষেত দেখে ঘটনাটির সত্যতা মিলেছে। এলাকার অর্ধশত কৃষক ভেজাল মরিচ বীজ কিনে ঠকেছেন। নষ্ট বীজের কারণে কৃষকরা ভেঙে পড়েছেন। তারা এবছর মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছেন। আমি চাই দেশের প্রাণ কৃষকদের সঙ্গে যাঁরা প্রতারণা করেছে, ভেজাল বীজ বিক্রি করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তাদেরকে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। এইজন্য প্রশাসনের কাছে ভুক্তভোগী কৃষকদের পক্ষথেকে দাবি জানাচ্ছি।

নয়াচরের কৃষক জাহাংগীর আলম অন্যান্য বছরের মতো এবারও দুই কানি জমি ৬০ হাজার টাকা দিয়ে লাগিয়ত নিয়ে চাষ করেছেন মরিচ ক্ষেতের। প্রতিকানিতে চাষ বাবদ খরচ পড়েছে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা করে। কিন্তু নিম্মমানের মরিচ বীজ রোপন করে সর্বস্থ হারিয়ে পথে বসেছেন চকরিয়া উপজেলার পূর্ববড়ভেওলা ইউনিয়নের আনিসপাড়া গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, বেতুয়া বাজারের আলতাফ হোছাইনের বীজের দোকান থেকে সান ড্রপ কোম্পানীর মরিচের বীজ ক্রয় করে তার জমিতে রোপন করেছেন। ভাল বীজের কথা বলে ভেজাল বীজ দিয়ে সব মরিচ গাছ মরে গেছে। সার-বিষ প্রয়োগ করেও বাঁচাতে পারেনি। তার অন্তত দুই লক্ষাধিক টাকা ক্ষতি হয়েছে বলেও দাবী করেন কৃষক জাহাঙ্গীর আলম।

একই ধরণের অভিযোগ তুলেছেন পূর্ববড়ভেওলা ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের আনিসপাড়া নয়াচরে কৃষক আবদুর রশিদ। তিনি বলেন, তার মরিচ ক্ষেত রয়েছে ২ কানি। দুই কানিতে ৪ লক্ষাধিক টাকা ক্ষতি হয়েছে। এভাবে কৃষক রাশেদুল ইসলামের ২ কানি, জকরিয়ার ২ কানি, জয়নাল আবেদিনের ২ কানি, আনোয়ার হোসেনের ২কানি, বাপ্পীর দেড় কানি, বশির আহমদের ২ কানি, জামাল হোসেনের দেড় কানি, রহমত উল্লাহর ২ কানি, ফজল কাদের পাখির দেড় কানি, মো: বাবুলের ৩ কানি, আবুল কাসেমের ২ কানি, ইব্রাহিমের ২ কানি, শওকত ওসমানের আড়াই কানি, আবু ছিদ্দিকের ২ কানি, ইলিয়াছের ২কানি, ইব্রাহিমের এক কানি, আবদুর রশিদের ৫ কানি, ফজল কাদেরের দেড়কানি, বাবু মিয়ার ৩ কানি, আবুল বশরের ২কানি, তহিদুল ইসলামের ৩ কানি, আবদুল মোনাফের ৬ কানি, মোস্তাক আহমদের এককানি, আবদুর রহিমের এককানি ও ও জামালের দেড় কানি জমির মরিচ ক্ষেত হয়েছে। বেতুয়াবাজারের বীজ বিক্রেতা আলতাফ হোছাইন ও মোস্তফার কাছ থেকে অর্ধশতাধিক কৃষক মরিচের বীজ কিনে বীজতলা তৈরি করে। ভেজাল বীজ দিয়ে যে সকল কৃষক জমি রোপন করেছেন তারা সবাই প্রতারিত হয়েছে। পথে বসেছেন অর্ধশতাধিক কৃষক। এসব কৃষকের অন্তত অর্ধকোটি টাকা ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

ভুক্তভোগী কৃষকেরা জানান, উপজেলার প্রতিটি জনপদে ভেজাল ও নিম্নমানের বীজে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। ডিলারের দোকান থেকে বিভিন্ন সবজির নিম্নমানের বীজ কিনে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে। নিম্নমানের বীজ জমিতে রোপন করে ফসল না পাওয়ায় লাখ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে কৃষকদের। চরম ক্ষতির মুখে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন অনেকে। অভিযুক্ত বীজ ডিলারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের কাছে দাবি জানান ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা।

ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা জানান, চকরিয়া পৌরশহরসহ বেতুয়াবাজারের মোস্তফা ও আলতাফের দোকানে দীর্ঘদিন ধরে নিম্নমানের খোলা বীজ বিক্রি আসছে। আমদানীকৃত প্যাকেটের বীজ খুলে নিম্নমানের সেই বীজগুলো প্যাকেটে ভরানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্থরা। বিভিন্ন ধরনের বীজ কিনে হাজার হাজার টাকা খরচ করে জমিতে রোপন করার পর চারা গজায়নি। আবার কিছু জমিতে চারা গজালেও ফলন হয়নি।

বেশির ভাগ কৃষকের অভিযোগ, শহীদ এগ্রো ও সুপ্রীম সীড কোম্পানীর নিম্নমানের বীজ দিয়ে প্রতারণা করে তাদের কাছ থেকে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আর চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কৃষক।

অভিযোগ অস্বীকার করে শহীদ এগ্রো সীডের পরিচালক শহীদুল ইসলাম জানান, তার কোম্পানীর বীজ উন্নত মানের। মরিচ বীজ সমস্যার হওয়ার কথা না। বিদেশ থেকে আমদানী করা বীজ বিক্রি করছেন। এরপরও তদন্ত করার কথা জানান তিনি। একই কথা বললেন সানড্রপ কোম্পানীর চকরিয়ার বিক্রয় প্রতিনিধি আরফাত। তিনি বলেন, আমরা ভেজাল বীজ বিক্রি করিনা। আমার কোম্পানি উত্তর কোরিয়া থেকে উন্নত মানের বীজ আমদানী করেন। সেখানে ভেজাল করার কোন সুযোগ নেই।

কীটনাশক বিক্রেতা আলতাফ হোছাইন বলেন, অনেক বছর ধরে কীটনাশক ও বীজ বিক্রি করছি। কোনদিন ভেজাল বীজ বিক্রি করেনি। এবার সানড্রপ কোম্পানীর বীজ বিক্রি করে এ সমস্যা পড়ছে হয়েছে।

নয়াচর ব্লকে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা জনী নন্দী বলেন, চাষের শুরু থেকে ফলন উঠা পর্যন্ত কৃষকদেরকে চাষের সব বিষয়ে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। গাছ যাতে মারা না পড়ে বা ফলন যাতে বিপর্যয় না ঘটে সেইজন্য কৃষি বিভাগের পক্ষথেকে মনিটরিং নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু এখন ক্ষেতের সব মরিচ গাছ মরে যাচ্ছে। মুলত এটি বীজ কোম্পানীর ভেজাল বীজ বিক্রির কারণে ঘটেছে।

কৃষকের অভিযোগ প্রসঙ্গে সুপ্রীম সীডের কক্সবাজার অঞ্চলের (চকরিয়া) সেলস্ ম্যানেজার আরাফাত হোসেন বলেন, আমাদের বীজ মুলত আমদানি করা হয় চীন থেকে। ক্রেতা কৃষক ছাড়া বাংলাদেশে অন্য কোথাও বীজের প্যাকেট খোলার সুযোগ নেই। সেখানে ভেজাল বীজ প্যাকেটজাত করার প্রশ্নই আসেনা। তিনি বলেন, স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা সুপ্রীম সীড থেকে উপহার নিতে আবদার করে। তাকে দিইনি বলেই কৃষকদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। ভেজাল বীজের বিষয়টি তিনি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, অতিবৃষ্টিতে পানি জমে থাকার কারণে মরিচ গাছে পঁচন ধরে। এরপর গাছ মরে যাচ্ছে।

বিষয়টি অবগত করা হলে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ সামসুল তাবরীজ বলেন, ভেজাল বীজ বিক্রির মাধ্যমে কৃষকের সঙ্গে প্রতারণায় জড়িতদের কোন ছাড় নেই। লিখিত অভিযোগ ভেজাল বীজ বিক্রিতে জড়িতের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ##

 

পাঠকের মতামত: