ঢাকা,মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

ঘূর্ণিঝড় আইয়্যের…..

সুপার সাইক্লোনে রূপ নিল আম্ফান ।। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত ।। উপকূলে আঘাত হানতে পারে কাল

নিউজ ডেস্ক ::
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় আম্ফান সর্বোচ্চ তীব্রতার ‘সুপার সাইক্লোনে’ পরিণত হয়েছে। আগামীকাল বুধবার এটি উপকূলে আঘাত হানবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আবহাওয়াবিদরা জানাচ্ছেন, তীব্রতার মাপকাঠিতে এই ঘূর্ণিঝড় এর মধ্যে অনেক রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রে ঝড়ের মধ্যে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২২৫ কিলোমিটার, যা দমকা ও ঝড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় প্রায় ২৪৫ কিমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ বার্তায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে ৬ নং বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় সংকেত ব্যবস্থায় ৫ থেকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত একই মাত্রার ঝুঁকি বোঝায়। বন্দরকে ডান দিকে রেখে ঝড় গেলে ৬ এবং বন্দরের উপর বা আশপাশ দিয়ে গেলে ৭ নম্বর সংকেত দেখাতে বলা হয়। দুই ক্ষেত্রেই নিশানে দুটি লাল রঙের সংকেত পতাকা দেখানো হয়।

খবরে বলা হয়েছে, ঝড়টি এখন উত্তর-উত্তর-পূর্ব অভিমুখে এগোচ্ছে। কাল বুধবার এটি পশ্চিমবঙ্গের দীঘা আর বাংলাদেশের হাতিয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের দীঘার মাঝামাঝি কোনো একটা এলাকা দিয়ে উপকূল অতিক্রম করবে। ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে বাতাসের গতিবেগ উঠে যাচ্ছে ২৬৫ কিমি পর্যন্ত। তবে উপকূলে আঘাত হানার সময় এর শক্তি কিছুটা কমে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।

এ সময় বাতাসের বেগ ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিমির মতো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে কোনো ঝড়ের কেন্দ্রে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটারের উপরে উঠে গেলে তাকে সুপার সাইক্লোন বলা হয়। আর প্রাক-বর্ষা মৌসুমে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া এ শতাব্দীর প্রথম সুপার সাইক্লোনের জায়গা দখল করে নিল আম্ফান। এর প্রভাবে আজ মঙ্গলবার থেকে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টি শুরু হতে পারে। বুধবার সকাল থেকে তার সঙ্গে যোগ হবে তীব্র ঝড়ো বাতাস।

আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা করেছেন, অমাবস্যার প্রভাবের কারণে ঘূর্ণিঝড়টি বাড়তি শক্তি সঞ্চয় করতে পারে এবং বিশেষত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং চট্টগ্রামের মধ্য উপকূলীয় অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে বেশি প্লাবিত হতে পারে। তারা আম্ফানকে একটি শক্তিশালী ‘ক্যাটাগরি-৪’ ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যা পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আটলান্টিক হারিকেন বা সুপার টাইফুন হিসেবে বিবেচিত।

সিএনএন টেলিভিশন বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানায়, এই মাত্রার ঘূর্ণিঝড় প্রবল বেগে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পর দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে এর আগে ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে। এমনকি ৩০ ফুট (৯ মিটার) পর্যন্ত উচ্চ জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা থাকে।

চট্টগ্রাম আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ শেখ ফরিদ আহমদ গত রাতে বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এখনো চট্টগ্রাম থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে রয়েছে। চার-পাঁচশ কিলোমিটারের ভেতরে আসলে কোন দিকে যেতে পারে তার একটি স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যেতে পারে। তারপরও ধারণা করা হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়টি অনেক গতি সম্পন্ন। এটি যদি আঘাত হানে তাহলে ১৯৯১ সালের সাইক্লোনকেও হার মানাতে পারে।

আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, ঝড়টির বর্তমান অবস্থান থেকে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে ধাবিত হতে থাকবে। আজ শেষ রাত থেকে বুধবার সন্ধ্যার মধ্যে এটি খুলনা থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলবর্তী অঞ্চল দিয়ে আঘাত হানতে পারে। তবে বাংলাদেশের নিকটবর্তী পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাব আরো বেশি শক্তিশালী ও তীব্র থাকতে পারে।

এদিকে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান উপকূলের দিকে এগিয়ে আসার খবরে চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা উপকূল, বাঁশখালী, আনোয়ারা উপকূলের বাসিন্দাদের মধ্যে নতুন করে আতংক বিরাজ করছে। করোনা মহামারির মধ্যে লোকজন দুর্ভোগে রয়েছে। তার ওপর আম্ফান চট্টগ্রামের লোকজনের মাঝে নতুন করে আতংক ছড়াচ্ছে।

উপকূলের আতংকগ্রস্ত বাসিন্দারা বলছেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আইয়্যের।’ তারা একে অপরকে সতর্ক হওয়ার জন্যও বলছেন।
চট্টগ্রাম আবহাওয়া অধিদপ্তরের গতকাল সন্ধ্যা ৬টার স্থানীয় পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় আকাশ আংশিক মেঘলা থেকে সাময়িকভাবে মেঘাচ্ছন্ন থাকতে পারে। সেই সাথে কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ী দমকা কিংবা ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি কিংবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি পেতে পারে। গতকাল চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বনিম্ন ২৬.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সর্বশেষ গতকাল রাত ৯টার বুলেটিনে বলা হয়েছে, পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত সুপার সাইক্লোন আম্ফান উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এটি গতকাল রাত ৯টায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ১০২০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে, কঙবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৯৬০ কিমি দক্ষিণ-পশ্চিমে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৯২০ কিমি দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৯১০ কিমি দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড়টি আরো উত্তর দিকে অগ্রসর হতে পারে এবং পরবর্তীতে দিক পরিবর্তন করে উত্তর-উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে আজ দিবাগত শেষ রাত থেকে আগামীকাল বুধবার বিকাল কিংবা সন্ধ্যার মধ্যে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

সুপার সাইক্লোন কেন্দ্রের ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২৫৫ কিমি, যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২৬০ কিমি পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটে সাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরসমূহকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।

অন্যদিকে চট্টগ্রাম ও কঙবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কঙবাজার তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। ঘূর্ণিঝড় এবং অমাবস্যার প্রভাবে চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪-৫ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে চট্টগ্রামসহ সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী জেলাসমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘণ্টায় ১৪০-১৬০ কিমি বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতিসত্বর নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হয়েছে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুয়েক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা কিংবা ঝড়ো হাওয়া ও বিজলি চমকানোসহ বৃষ্টি কিংবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সারা দেশে দিনের তাপমাত্রা ২-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস পেতে পারে ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে।

আবার সুন্দরবন? : বিডিনিউজ সূত্রে জানা যায়, জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার আম্ফানের সম্ভাব্য যে গতিপথ দেখিয়েছে, তাতে উপকূল অতিক্রম করার সময় এ ঝড়ের কেন্দ্র বা চোখ থাকতে পারে সুন্দরবনের ওপর। ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং ২০০৭ সালের নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডরও স্থলভাগে উঠে এসেছিল সুন্দরবন উপকূল দিয়ে। এর মধ্যে আইলায় বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১২০ কিলোমিটার। আর সিডরের শক্তি ছিল তার দ্বিগুণেরও বেশি, ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার। সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় বুলবুল গত বছর নভেম্বরে ঘণ্টায় ১১৫ কিলোমিটার থেকে ১২৫ কিলোমিটার বেগের বাতাসের শক্তি নিয়ে একই দিক দিয়ে উপকূলে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলকে অনেকটাই রুখে দেয় সুন্দরবন।

আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক ড. মোহন কুমার দাশ জানান, এপ্রিল ও মে মাসে ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুমে ভারত মহাসাগরে যেসব ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয়েছে, তার আগে অনেকগুলোই বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার উপকূলে আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ছিল মালা (২০০৬), নার্গিস (২০০৭), বিজলি (২০০৯), মারুথা (২০১৭) ও ফণী (২০১৯)। আর মে মাসের ঘূর্ণিঝড় ছিল আকাশ (২০০৭), আইলা (২০০৯), লায়লা (২০১০), ভিয়ারু (২০১৩), রোয়ানু (২০১৬), মোরা (২০১৭)।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমেছে। বুয়েটের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক ড. মোহন বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির এ সময়ে ‘শূন্য ক্যাজুয়ালিটি’ পলিসি নির্ধারণ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিতে হবে। সাধারণ জনগণ যেন সতর্কতা েেবাঝে, মানে ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সচেতন থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

পাঠকের মতামত: