ঢাকা,শুক্রবার, ৩ মে ২০২৪

পোকখালীর আশু মাঝিরঘাট কেন্দ্রিক মানব পাচারকারী সিন্ডিকেট আবারো সক্রিয়!

মোঃ রেজাউল করিম, ঈদগাঁও, কক্সবাজার :: কক্সবাজার সদর উপজেলার পোকখালী ইউনিয়ন একটি উপকূলীয় এলাকা। লবণ এবং মৎস্য সম্পদের জন্য এলাকাটি বেশ প্রসিদ্ধ। জাতীয় অর্থনীতিতে এ এলাকার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ইউনিয়ন থেকে দুইজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে একজন মহিলা এবং অনজন পুরুষ। মহিলা সংসদ সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন সংরক্ষিত আসন থেকে। এ ইউনিয়ন থেকেই কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বর্তমান সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ ইউনিয়নের অন্তর্গত গোমাতলী এলাকার। যদিও তিনি বর্তমানে সপরিবারে কক্সবাজার শহরে অবস্থান করেন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির মৎস্যজীবী বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক সাংসদের গ্রামের বাড়ি এ ইউনিয়নে। যার মরহুম পিতা কক্সবাজার জেলার শিল্প উন্নয়নের অন্যতম পুরোধা হিসাবে পরিচিত। ইসলামী ঐক্যজোটের জেলা শাখার প্রভাবশালী নেতার বাড়িও এ ইউনিয়নে। আল্লাহ প্রদত্ত অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি এ ইউনিয়নটি অনেক মেধাবী ব্যক্তির জন্ম দিয়েছেন। জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা এ ইউনিয়নেরই সন্তান। এখানকার অনেক কৃতি সন্তান দেশেবিদেশে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত রয়েছেন। যারা দেশের অগ্রযাত্রায় নানাভাবে ভূমিকা রাখছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এলাকার কিছু কুচক্রী স্বনামধন্য এ ইউনিয়নটিকে সমালোচনার মুখে ফেলেছে। এ ইউনিয়নের পশ্চিম পোকখালীর অদূরে আশু মাঝিরঘাট। এ ঘাটটি দীর্ঘ ৪০ বছরেরও বেশি পুরনো এবং ঐতিহ্যবাহী ঘাট । যা এক সময় খুবই কর্মব্যস্ত ছিল। সময়ের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বর্তমানে এ ঘাটটি তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। দীর্ঘদিন যাবৎ এ ঘাট দিয়ে গবাদি পশু, কাঁচা বাজার সহ যাত্রী পরিবহন করা হয়। নৌকা যোগে বৃহত্তর ঈদগাঁও এলাকার গবাদিপশু, তরিতরকারি মহেশখালী ও কক্সবাজারে পারাপারের জন্য এ ঘাট খুবই প্রসিদ্ধ। এ ঘাটে সব সময় একাধিক বোট অবস্থান করে। যা দ্বারা এপার ওপার এর মধ্যে সংযোগ রক্ষা করা হয়। অতীতে এঘাট  দিয়ে একাধিকবার মালেশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে মানব পাচারের অভিযোগ ছিল। সে সময় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর দল একাধিকবার ঘাটে তল্লাশি চালিয়েছিলে। পত্রপত্রিকায় এ বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন রিপোর্ট ও প্রকাশিত হয়েছিল। গণমাধ্যমের নজরে আসার পর সক্রিয় মানব পাচারকারী চক্র তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। স্থানীয় একটি সিন্ডিকেট মানব পাচারে জড়িত ছিল। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পহস বিভিন্ন স্থান থেকে মিয়ানমারের নাগরিকসহ মালয়েশিয়া যেতে ইচ্ছুক লোকদেরকে জড়ো করে রাতের অন্ধকারে পাচার করত। এ চক্রের সাথে কক্সবাজারের নাজিরারটেক এবং সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের দালালদের যোগসাজশ ছিল। স্থানীয় চক্রটি তৎকালীন প্রশাসনকে ম্যানেজ করে এ ঘাটটিকে নিরাপদ মানব পাচারের ট্রানজিট পয়েন্টে রূপান্তর করেছিল। বছর তিনেক বিরতির পর বর্তমানে আবারো চলছে তাদের দৌরাত্ম্য ও অপকর্ম। লোক চক্ষুর অন্তরালে গভীর রাতে আবারো চক্রটি মানব পাচারে জড়িত হয়ে পড়েছে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন সূত্রের বরাতে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, কয়েকদিন পর পর স্থানীয় ওই দুষ্ট চক্রের সহায়তায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশীদের মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে পাচার করা হচ্ছে এ ঘাট ব্যবহার করে। এখান থেকে একটি বোট করে বিদেশ গমনেচ্ছুকদের নাজিরারটেকের অন্য একটি বোটে হস্তান্তর করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পাচারকৃতদের অধিকাংশই মহিলা এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আগত। কিছুদিন আগে এভাবে পাচারের উদ্দেশ্যে জড়ো করা অপরিচিত লোকদের স্থানীয় দেলু নামের একজনের বাড়িতে সাময়িক অবস্থান করানোর জন্য পাচারকারী সিন্ডিকেটের কেউ কেউ আবদার করলেও তিনি তাতে রাজি হননি বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রমতে, পাচারকারী চক্রটি মানব পাচার বাবদ প্রতি ট্রিপে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এ ব্যাপারে ঘাট ইজারাদার জসীম উদ্দীনকে কেউ কেউ অভিযোগ ও করেছিলেন বলে জানা গেছে। বিষয়টি ইউপি চেয়ারম্যান রফিক আহমেদকেও জানানো হয়েছিল বলে স্থানীয়় একটি সূত্র নিশ্চিত করেছেন। অন্যদিকে ঈদগাঁও ইউনিয়নের শিয়া পাড়ার জনৈক সোনাা মিয়া আশু মাঝিরঘাট দিয়ে মানব পাচারের বিষয়টি ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের এক উপ-পরিদর্শককে অবহিত করেছিলেন। তবে চলমান মহামারী করোনা দুর্যোগের কারণে এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি বলে সূত্রে জানা গেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, ঘাট ইজারাদার জসিম ও তার সহযোগী আবদুস সবুর, সৈয়দ নূর প্রকাশ মেম্বার এবং আবুু কাউসার কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে প্রকৃত রহস্যয বেরিয়ে আসতে পারে। তবে এ ঘাট দিয়ে মানব পাচারের বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে ইজারাদার জসিম উদ্দিন বলেন, আমি এ ধরনের মানুষ নই। আপনারা এসে সরেজমিন যাচাই করে দেখতে পারেন। ঘাটটি বর্তমানে তেমন চালু নেই। চৌফলদন্ডীতে  ব্রিজ হওয়াই লোকজন সে ব্রিজ দিয়ে কক্সবাজারে যাতায়াত করেন। গত কয়েকদিন আগে একটি গরু পরিবহন কে কেন্দ্র করে স্থানীয় অনেকে মানব পাচার করা হচ্ছে বলে এখানে জড়ো হন। ঘাটে যে বোট রয়েছে তা তিনি নিজে চালান না বলে জানিয়ে বলেন, তার চাচাতো ভাই কাউসার এখন ঘাটে বোটটি পরিচালনা করেন। তবে তিনি অতীতে এ ঘাট দিয়ে মানব পাচারের বিষয়টি স্বীকার করেন বলেন, বর্তমানে জালালাবাদের কিছু ব্যবসায়ী এঘাট দিয়ে হলুদ, তেঁতুল সহ নানা পণ্য সামগ্রী গোরকঘাটা বাজারে নিয়ে যান। স্থানীয় মেম্বার লুৎফুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, মানব পাচারের অভিযোগে আমিও শুনেছি। বিষয়টি আমার নজরদারিতে রয়েছে। নিজ চোখে দেখার চেষ্টা করছি। স্থানীয়রা আমাকে বলেছেন বিষয়টি চেয়ারম্যান কে জানানো হয়েছে। তিনি অতীতে এ ঘাট দিয়ে মানব পাচারের বিষয়টি সত্য বলে জানিয়ে বলেন, তার পিরিয়ডের পূর্বে এখান থেকে অহরহ মানব পাচার সংঘটিত হয়েছে। তবে বর্তমানের অভিযোগটি না দেখা পর্যন্ত তিনি নিশ্চিত হতে পারছেন না। নিশ্চিত হলে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। এ বিষয়ে কথা বলতে ইউপি চেয়ারম্যান রফিক আহমদ এর মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করেও মোবাইল রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। ঈদগাঁও পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ আসাদুজ্জামান খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, কেউ তার কাছে এ সংক্রান্ত কোন অভিযোগ দেন নি। অভিযোগ পেলে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। তিনি আরো বলেন, ঘটনাস্থলটি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা এবং ওই স্থানে যেতে প্রায় তিন মাইল হাঁটতে হয়। এদিকে হাল আমলের মানব পাচারের বিষয়টি ব্যাপারে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক কানাঘুষা চলছে। তারা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। এলাকায় রোহিঙ্গা প্রবেশ করলে করোনা সংক্রমনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তারা।

পাঠকের মতামত: