ঢাকা,মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪

উত্তপ্ত চট্টগ্রাম কলেজ, সক্রিয় বিবদমান তিনটি গ্রুপ

তাজুল ইসলাম পলাশ, চট্টগ্রাম :

২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর শিবিরের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম কলেজ থেকে শিবিরকে বিতাড়িত করার পর কলেজ নিয়ন্ত্রণ নেয় ছাত্রলীগ। এর পর থেকেই অভ্যন্তরীন কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে বিবদমান দুটি গ্রুপ। গত দুই বছরে কমপক্ষে ২৫ বার নিজেদের সংঘর্ষ হয়। আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধশতাধিক। তাদের এ ধরনের আচরণে বিরক্ত ছিল কেন্দ্রও। একপর্যায়ে সেখানে কোনো কার্যক্রম নেই বলেও ঘোষণা দিয়েছিল কেন্দ্র। এমন পরিস্থিতিতে এসে গত ১৭ সেপ্টেম্বর সোমবার রাতে নগর ছাত্রলীগ ঘোষণা করে ২৫ সদস্যের কলেজ কমিটি। দীর্ঘদিনের বিরোধ নতুন করে চাঙ্গা হয়। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে কলেজ ক্যাম্পাস। আবারো প্রকাশ্যে জড়িয়ে পড়ে দুটি গ্রুপ। এর পরদিন মঙ্গলবার কমিটি বাতিলের দাবীতে রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে পদবঞ্চিতরা। এসময় উভয় পক্ষের সংঘর্ষে এক সাংবাদিকসহ তিনজন আহত হয়। সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে ব্যাপক ককটেল বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসময় প্রকাশ্য অস্ত্র হাতে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায় এক যুবককে। কয়েকজন যুবককে দেশীয় অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া দেয়। সংঘর্ষ চলাকালীন সময়ে আতংক ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম কলেজের পাশে অবস্থিত মহসিন কলেজ ও ৩টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাঝে।

এর আগে ২০১৭ সালের ১২ জুলাই আধিপাত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নুর মোস্তফা টিনুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত সবুজ ও দোলন গ্রুপের মধ্যে শ্রেণিকক্ষে সংঘর্ষ হয়েছিল। এতে উভয়পক্ষের ১২ জন আহত হয়েছিলেন। এছাড়া একইদিন সংঘটিত অপর ঘটনাটি ঘটেছিল ওবায়দ গ্রুপ ও সম্রাট গ্রুপের মধ্যে। ১১ জুলাইও ওবায়দ ও সম্রাট গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল।

২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইংরেজি বিভাগের সেমিনার কক্ষে বসা নিয়ে তৎকালীন নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী নুরুল ইসলামের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছিলেন চারজন।

২০১৬ সালের ১৯ জুন আধিপত্য বিস্তার ও ভর্তিচ্ছুদের স্বাগত জানানোকে কেন্দ্র ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়েছিল। যারা নগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত আলহাজ্ব এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব আ.জ.ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। এর আগের দিন ১৮ জুনও ভর্তিচ্ছুদের স্বাগত জানানোকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছিলেন তিনজন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজ থেকে শিবিরকে বিতাড়িত করতে নগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ নুরুল আজিম রনি ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনু অনুসারীরা এক জোট হয়ে কাজ করে। কিছুদিন নিজেদের মধ্যে ভাল সম্পর্ক থাকলেও বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে উভয় গ্রুপ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। তারা এর আগেও ২০১৬ সালে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়েছিল। ওই সময় চকবাজার থানার একজন ওসিকে বদলী করা হয়েছিল দুই গ্রুপের কোন্দলের কারনেই। বর্তমানে চট্টগ্রাম কলেজে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহীবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’র অনুসারী হিসেবে পরিচিত তিনটি গ্রুপ সক্রিয়। বিভিন্ন সময়ে এসব গ্রুপের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়ে আসছিল। তার মধ্যে আ জ ম নাছিরের পক্ষে একাধিক গ্রুপ সক্রিয় ছিল। নওফেলের পক্ষে সক্রিয় নেতা চট্টগ্রাম কলেজের সদ্য ঘোষিত কমিটির সভাপতি মাহমুদুল করিম এবং নুরুল ইসলাম বিএসসি’র অনুসারী হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা নুর মোস্তফা টিনু গ্রুপ হিসেবেই পরিচিত ছাত্রলীগের আরেক অংশ। টিনুর অনুসারীদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে একাধিক গ্রুপ দেখা গেছে। এরমধ্যে সদ্য ঘোষিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজ অন্যতম।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কলেজে মেয়র আ জ ম নাছিরের পক্ষের প্রতিনিধি নগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি এম কায়সার উদ্দিন বলেন, ‘কমিটির নেতারা আমাদের বিক্ষোভের ভয়ে ক্যাম্পাসে আসছে না। কারণ ক্যাম্পাসে পকেট কমিটির নেতা

দের আমরা অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছি।’

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কলেজের নবগঠিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজ বলেন, ‘আমরা ভয়ে নয়, তাদের ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছি। কয়েকদিন পর এমনিতে ঠিক হয়ে যাবে। সব জায়গায় কমিটি নিয়ে এরকম হয়ে থাকে।পরে দেখা যায় সব ঠিক হয়ে গেছে।

নগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ওয়াহেদ রাসেল জানান, ‘মাহতাব ভাই ও নাছির ভাইয়ের কঠোর নির্দেশের কারণে ঐক্যবদ্ধভাবে ছাত্রলীগের কর্মকান্ড চলে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কমিটি দেয়া হল বুঝতে পারছি না। কমিটি দেয়া মানেই বিরোধ, কিন্তু সমন্বয় না থাকলে তো কথাই নেই। এখানেও তাই হয়েছে। এখন ইলেকশন পিরিয়ড। সবার সাথে আলাপ করে সমন্বয় করা যেত। কিন্তু তা করে নি।

এদিকে আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিয়েছে মেয়র নাছিরের অনুসারী বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ কর্মীরা। সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম কলেজের কমিটি প্রত্যাখ্যান করে ৭জন নেতা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগ করবেন বলে জানা গেছে।

সিএমপির সহকারী কমিশনার (চকবাজার জোন) নোবেল চাকমা জানান, যেকোন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে।

উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে সর্বশেষ চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি হয়েছিল। ছাত্র শিবিরের সহিংস কর্মকান্ডের কারণে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হওয়া ছাত্রলীগের প্রায় তিন দশক ধরে ওই কলেজে কোন কর্মকান্ডই ছিল না। ২০১৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম কলেজ ও সরকারি হাজী মুহম্মদ মহসিন কলেজ ক্যাম্পাস দখলে নেয়। এরপর থেকে কলেজ দুটিতে তাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলে আসছে। ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম শুরুর তিন বছর পর গত সোমবার রাতে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের ২৫ সদস্যের আংশিক কমিটির অনুমোদন দেন নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর। কমিটিতে মাহমুদুল করিমকে সভাপতি এবং সুভাষ মল্লিক সবুজকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। মাহমুদুল প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী এবং সবুজ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসির অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

পাঠকের মতামত: