ঢাকা,সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

শিশু চুরির ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট

অনলাইন ডেস্ক ::

শিশু চুরির সিন্ডিকেট তৎপর হয়ে উঠেছে। হাই কোর্টের আদেশ, র‌্যাব-পুলিশের অব্যাহত অভিযান, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন রকম তৎপরতার পরও শিশু চুরির ঘটনা থামছেই না। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতার ফাঁক গলে ঘটছে এসব শিশু চুরির ঘটনা। আগে রাজধানীতে হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে শিশু চুরির ঘটনা ঘটলেও ইদানীং এর দৌরাত্ম্য সারা দেশে বিস্তৃত হয়েছে।

ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট, বরিশাল ও কুমিল্লার বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিক থেকেও বেশ কয়েকটি শিশু চুরির ঘটনায় অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে কোহিনুর ও মনোয়ারা সিন্ডিকেট বেশি ভয়ঙ্কর। সারা দেশে এ চক্রের অর্ধশতাধিক সদস্য সক্রিয়। এ পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতাল-ক্লিনিকে যতগুলো শিশু চুরি হয়েছে, ঘুরেফিরে এই সিন্ডিকেটের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। জানা গেছে, রাজধানীর সরকারি হাসপাতাল, বেসরকারি ক্লিনিক ও নার্সিং হোম ঘিরে ‘বহিরাগত আয়া’দের সমন্বয়ে শিশু চুরি ও বেচাকেনার শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ড থেকে চুরি করা শিশুদের বিক্রি করছে। বড়জোর তিন-চার হাজার টাকা, এমনকি এর চেয়েও কম দামে বিক্রি হচ্ছে ছেলে কিংবা মেয়েশিশু। সামান্য বকশিশের বিনিময়ে গ্রাহকের পছন্দমাফিক ‘নবজাতক’ পাল্টে দেওয়ার অপকর্মও করছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ক্ষেত্রবিশেষ চুরি যাওয়া এসব শিশুর দাম ওঠে ২-৩ লাখ টাকা।

২০১৭ সালের ১৭ নভেম্বর তিন মাসের শিশু জিমকে হারিয়ে ফেলেন মা সুমাইয়া। পরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সহায়তায় উদ্ধার হয় শিশু জিম। তবে ২০১৬ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ঢামেক হাসপাতাল থেকে নাসিমা খাতুনের সাড়ে তিন মাসের শিশু খাদিজা আক্তার চুরি হলেও গতকাল পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি।

২০১৪ সালের ২০ আগস্ট ঢামেক হাসপাতালের ২১৩ নম্বর লেবার ওয়ার্ড থেকে রুনা বেগমের দুটি যমজ নবজাতকের একটি চুরির ঘটনা ঘটে। ২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন ও তার স্ত্রী শিল্পীর নবজাতক শিশু ঢামেক হাসপাতালের ২১২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে চুরি হয়। এসব শিশু চুরির ঘটনা হাসপাতালের সিসি টিভির ক্যামেরার ফুটেজে ধরা পড়ে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন বলেন, ‘শিশু চুরিসহ নানা ধরনের অপরাধ ঠেকাতে আমরা বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। উন্নতমানের নাইটভিশন আইপি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। বর্তমানে মোট ক্যামেরার সংখ্যা ১১৮টি। পর্যায়ক্রমে ক্যামেরার সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।’ তিনি বলেন, শিগগিরই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ঢামেক হাসপাতাল চত্বরে বিশেষ অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।

র‌্যাব-৩ অধিনায়ক লে. কর্নেল এমরানুল হক বলেন, ‘শিশু চুরি সিন্ডিকেটে বিভিন্ন ধরনের লোক জড়িত। তদন্তে দেখা যাচ্ছে, নিঃসন্তান দম্পতিদের চাহিদা মেটানোর জন্য এ সিন্ডিকেট অন্য আরেক মায়ের কোল খালি করে ব্যবসা করে যাচ্ছে। ঢাকা মেডিকেলের আশপাশে গজিয়ে ওঠা নামমাত্র ক্লিনিকেই এ সিন্ডিকেটের সদস্যদের আখড়া। এই অপরাধ ঠেকাতে ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে কিছু সুপারিশ করেছি। জানতে পেরেছি তারা ওই সুপারিশ অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।’ ২৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ডের লেবার রুম থেকে নবজাতক চুরির সন্দেহে ডাক্তারি ইউনিফর্ম পরা রাজ (১৯) ও ফারজানা আকতার মণি (২৬) নামে দুজনকে আটক করে পুলিশ। এর আগে ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর শিশু চোর চক্রের সদস্য সন্দেহে দুজন নারীকে আটক করা হয়। ২০১৫ সালের ১৬ জুলাই নবজাতক চুরির ঘটনায় হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় সুজন দত্ত (৩০) ও তার স্ত্রী রীনা দে (৩২)-কে আটক করে র‌্যাব। অভিযোগ আছে, হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, আয়া, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তরা একশ্রেণির দালালের মাধ্যমে শিশু চুরিসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করে চলেছেন। হাসপাতালকে কেন্দ্র করে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয়। এদিকে হাসপাতালে বসানো সিসি ক্যামেরাগুলোর অধিকাংশই নষ্ট, যে কারণে শিশু ও পণ্য চুরিসহ নানা অপরাধ ঘটলেও অনেক সময় প্রয়োজনীয় প্রমাণের অভাবে অপরাধী শনাক্ত করা যায় না।

চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জালাল উদ্দিন বলেন, ‘শিশু চুরিসহ অন্যান্য অপরাধ দমনে আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা আছে। তবু অনেক সময় দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এ ব্যাপারে আমরা সবাইকে সতর্ক করেছি এবং নিজ দায়িত্ব কার্যকর ও সচেতনভাবে পালন করার জন্য বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ৩৭টি সিটি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে অনেকটিই নষ্ট। তবে এগুলো সংস্কার এবং নতুন কিছু লাগানোর ব্যাপারে আমরা দরপত্র আহ্বান করেছি। শিগগিরই ক্যামেরাগুলো লাগানো হবে। এ ছাড়া হাসপাতালে ৭০ জন আনসার সদস্য নিরাপত্তায় নিয়োজিত। আরও ১০০ জন আনসার নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।’

আটকে রাখা যায় না : শিশু চোরদের হাতেনাতে আটক করে মামলা দিয়েও জেলে আটকে রাখা সম্ভব হয় না। আইনের ফাঁক গলে তারা দ্রুতই জামিনে বেরিয়ে আসে। আবার আস্তানা বদলে একই জঘন্য কাজে মেতে ওঠে তারা। রাজধানীতে নবজাতক চুরির ‘গডমাদার’ হিসেবে চিহ্নিত দীপালির আস্তানায় নবজাতক বেচাকেনা আর রদবদল ঘটানো হয় হামেশা। মাত্র চার বছরের তৎপরতায়ই দীপালি ও তার সহযোগীরা ঢামেক হাসপাতাল, মিটফোর্ড ও আজিমপুর মাতৃসদন থেকে অন্তত ৩০টি নবজাতক চুরি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দীপালির ঘনিষ্ঠ সহযোগী হলেন নিলুফা বেগম, মুন্নী আক্তার ও নাসিমা বেগম। ইসমত আরা দীপালির বাসায় শিশু বিক্রির দরদাম চলাকালে নবাবপুর থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে হাতেনাতে এ চক্রের চারজনকে আটক করে। কিন্তু দুই সপ্তাহ না পেরোতেই সেই দীপালি ও তার সহযোগীরা আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আবার একই অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন।

সূত্র বলছে, শিশু চুরির সিন্ডিকেটের সদস্যরা ভুয়া নার্স-আয়ার পরিচয়ে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ঘুরে বেড়ায় এবং সুযোগ পেলেই নবজাতক চুরি করে নিয়ে যায়। এর আগে বিভিন্ন সময় চুরি করা নবজাতকসহ তারা বার বার আটক হলেও অদৃশ্য ইশারায় দ্রুতই ছাড়া পেয়ে আবার শিশু চুরির অপকর্মে লিপ্ত হয়।

পাঠকের মতামত: