ঢাকা,রোববার, ১৯ মে ২০২৪

চকরিয়ায় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত মুন্না, বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি পরিবারের

ইকবাল ফারুক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়ায় কথিত বন্দুকযুদ্ধে সাজেদুল হাসান প্রকাশ মুন্না (৩৩) নামক যুবক নিহতের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবী করেছেন নিহতের পরিবার। তিন বছরের সংসার জীবনের সাথী প্রিয় স্বামীকে হারিয়ে বুকফাটা আর্তনাদ করছেন নিহত মুন্নার অন্তসত্বা স্ত্রী তাসমীন আক্তার (২০)। তার মো. সাঈদ জাওয়াদ অভি নামে আড়াই বছরের এক ছেলে সন্তান রয়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জক্ষম ছেলেকে হারিয়ে মুন্নার মা আমেনা বেগম (৫০) ছেলের শোকে মুর্চা যাচ্ছেন বার বার। পুত্র শোকে মুহ্যমান দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সদ্য হাসপাতাল থেকে ফেরা মুন্নার বাবা আব্দুল কাদেরও ছিলেন নির্বাক। আদরের ভাইকে হারিয়ে মুন্নার সাত বোন ও একমাত্র ভাই জুয়েলের গগণ বিদারী কান্না এলাকার পুরো আকাশ বাতাসকে যেন ভারী করে তুলেছে। শুক্রবার বিকালে সরেজমিনে উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কোরবনিয়াঘোনস্থ মুন্নার বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।

নিহত মুন্নার মা আমেনা বেগমের দাবি, আমার ছেলে চোর, ডাকাত কিংবা সন্ত্রাসী নয়। বাংলাদেশের কোন থানা বা আদালতে আমার ছেলের বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত অভিযোগও নেই। যার বিরুদ্ধে চুরি ডাকাতির কোন অভিযোগ নেই এবং এ সংক্রান্ত অপরাধ সংঘঠিত করার ব্যাপারে কোন অতীত অভিজ্ঞতা নেই সে কিভাবে ডাকাতি করতে গিয়ে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়। তিনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলেন, পূর্ব শত্রæতার জেরে এলাকার একটি প্রভাবশালী মহল আমার ছেলেকে পরিকল্পিতভাবে ক্রস ফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে প্রচার করছে। আমি আমার ছেলে হত্যার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। নিরপেক্ষ তদন্তের ক্ষেত্রে চাই সাংবাদিকদের সহযোগীতাও।

নিহত মুন্নার মা আমনা বেগম বলেন, আমার বসত ভিটার জায়গা জমি নিয়ে পূর্ব থেকে এলাকার একটি প্রভাবশালী মহলের সাথে বিরোধ চলে আসছিল। এ বিরোধে ওই প্রভাশালীর সাথে যোগ দেয় স্থানীয় এক সমাজ সর্দার ও জনপ্রতিনিধি। এ পক্ষটি আমাদেরকে বসে আনতে না পেরে হয়রানীর উদ্দেশ্যে স্থানীয় গ্রামীণ আদালত, থানা ও আদালতে অন্তত ১০-১২টি মামলা দায়ের করে। তাদের এ ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পরবর্তীতে আমাদের পরিবারকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করার জন্য আমার একমাত্র উপার্জক্ষম ছেলেকে বেচে নেয় তারা। তাদের সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গত ২০১৯ সালে আমার ছেলেকে মাদক মামলা ও অপর এক স্কুল ছাত্রী ধর্ষণ মামলায় সন্দেহভাজন আসামী হিসেবে মামলায় ঢুকিয়ে দেয় ষড়যন্ত্রকারিরা। এরপর অনেক কষ্টের বিনিময়ে আমরা আমার ছেলের জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করি।

আমেনা বেগম বলেন, অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে স্বামী, সাত মেয়ে ও দুই ছেলেকে নিয়ে আমাদের সংসার চলছিল। আমাদের বড় ছেলে ছিল মুন্না। আর্থিক অনটনের কারণে ছেলে লেখাপড়া করতে না পারায় বাবার সাথে সংসারের ঘানি টানতে ব্রীকফিল্ডে ইট শ্রমিকের কাজে যোগ দেয় মুন্না। বাবা আর ছেলে আয় রোজগার দিয়ে মোটামুটি ভালই চলছিল আমাদের সংসার। কিন্তু হঠাৎ করে সাজানো মাদক মামলায় আমার ছেলের এক বছরের সাজা হওয়ার খবর পেয়ে গত রমজানের পর থেকে মুন্না তার পরিবার নিয়ে শশুড় বাড়ি চুনতির বড় হাতিয়ায় চলে যায়। সেখানে সে ব্যাটারী চালিত রিক্সা ও ভেন শ্রমিক হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতো।

আমেনা বেগম আরও বলেন, গত বুধবার রাত পৌনে ১০টায় সর্বশেষ আমার ছেলের সাথে কথা হয়। এ সময় আমার বাড়িতে অবস্থান নেয়া তার স্ত্রী সন্তাদের সাথেও কথা বলে মুন্না। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. ইসমাইল খবর দেয় চকরিয়ার আভ্যন্তরীণ সড়ক বানিয়ারছড়া-পঁহরচান্দা সড়কের বরইতলী ইউনিয়নের হারবাং ছড়া ব্রীজের পাশে মুন্নার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া গেছে। ডাকাতির প্রস্তুতির সময় পুলিশের সাথে গোলাগুলিতে সে মারা যায় বলেও জানান তিনি। পরে মরদেহ গ্রহনের জন্য তাকে চকরিয়া থানায় যাওয়ার কথা বলেন ইউপি সদস্য ইসমাইল।

মুন্নার মা সাংবাদিকদের কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন, আমার ছেলে চোর, ডাকাত কিংবা সন্ত্রাসী নয়। বাংলাদেশের কোন থানা বা আদালতে আমার ছেলের বিরুদ্ধে এ সংক্রান্ত অভিযোগও নেই। যার বিরুদ্ধে চুরি ডাকাতির কোন অভিযোগ নেই এবং এ সংক্রান্ত অপরাধ সংঘঠিত করার ব্যাপারে কোন অতীত অভিজ্ঞতা নেই সে কিভাবে ডাকাতি করতে গিয়ে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় ? এ সময় তিনি হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলেন, আমার ছেলে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা যেতে পারে না। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যাকরা হয়েছে। আমি আমার ছেলে হত্যার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। নিরপেক্ষ তদন্তের ক্ষেত্রে চাই সাংবাদিকদের সহযোগীতাও।

এদিকে মুন্নার বাড়ি থেকে বের হয়ে আশপাশের কয়েকজন যুবকের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। এ সময় তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মুন্নার সাথে এলাকার কতিপয় বেকার যুবকদের সাথে সম্পর্ক ছিল তা সত্য। কিন্তু তিনি এলাকায় তেমন কোন উল্লেখযোগ্য অপরাধ সংগঠিত করেননি। তবে ইতিপূর্বে পারিবারিক বিষয় নিয়ে স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির সাথে তার মারামারি হয় বলে জানান তারা।

প্রসঙ্গত: গত বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) ভোররাত পৌনে তিনটার দিকে চকরিয়ার আভ্যন্তরীণ সড়ক বানিয়ারছড়া-পঁহরচান্দা সড়কের বরইতলী ইউনিয়নের হারবাং ছড়া ব্রীজের সামান্য অদুরে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে মারা যায় যুবক সাজেদুল হাসান মুন্না।

পুলিশের দাবি, ডাকাতির প্রস্তুতিকালে টহলরত পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধেই মারা যায় মুন্না। এ সময় পুলিশের পাঁচজন সদস্যও আহত হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে থেকে দেশীয় তৈরি একটি বন্দুক (এলজি), দুটি কার্তুজ, একটি নম্বর প্লেট বিহীন মোটরসাইকেল, একটি লোহার শাবল, তিনটি বাটন মোবাইল, একটি কালো রংয়ের মাক্স ও একটি সবুজ রংয়ের মুখোশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় পৃথক তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ।

সে সময় পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানানো হয়, নিহত সাজেদুল হাসান মুন্না’র বিরুদ্ধে ডাকাতির কোন মামলা না থাকলেও তিনি একটি মাদক মামলায় এক বছরের সাজাপ্রাপ্ত ও আরেকটি ধর্ষণ মামলার আসামি ছিলেন।

পাঠকের মতামত: