ঢাকা,শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪

ক্রমেই মাছ শূন্য হয়ে পড়েছে নদ-নদী-খাল-বিল

হুমকিতে মাছের ভান্ডার: নিষিদ্ধ জালের ফাঁদ অপব্যবহার

চরঘেরা, বেহুন্দি, কারেন্ট জালের ফাঁদে মরছে জলজপ্রাণী 

কক্সবাজার প্রতিনিধি ::

নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সাগরে অবৈধ নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার ভয়াবহ রুপ ধারণ করেছে। এতে মাছের রেণু ও ডিম জলজ জীববৈচিত্র্য ব্যাপক হুমকিতে পড়েছে।

প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে চরঘেরা, কারেন্ট ও বেহুন্দি জাল পেতে মাছের বংশ নির্বংশ করা হচ্ছে। এই কারেন্ট জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে ডিমওয়ালা মাছ থেকে শুরু করে মাছের পোনা, সাপ, কুচিয়া, কাঁকড়া, ব্যাঙসহ নানা জলজপ্রাণী। এ কারণে সাগরের জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়েছে। শিকারীরা এসব জালের ফাঁদ বসিয়ে অবাধে মাছ শিকার করে যাচ্ছে।

এছাড়া কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপজেলার খাল-বিলে নিষিদ্ধ জালে মাছ শিকার হচ্ছে অবাধে। এতে মারা পড়ছে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আর পোনা। এসব জালে মাছ ধরা পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে মাছের মৃত্যু ঘটে। এতে করে ক্রমেই মাছ শূন্য হয়ে পড়ছে নদ-নদী, খাল-বিল ও ছোট নদীগুলো।

জেলা মৎস্য অধিদপ্তর অফিস সূত্র জানা যায়, গত ৮ জুলাই প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ১ লক্ষ ৫০ হাজার কারেন্ট জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর আগে ৫ জুলাই মহেশখালী চ্যানেল, সোনাদিয়া দ্বীপ ও ঘটি ভাঙ্গা, এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ২ লক্ষ ৩০ হাজার মিটার চরঘেরা জাল, ১ লক্ষ ৬০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল এবং ৭ টি মৎস্য নৌযান জব্দ করা হয়। গত মাসের ২২ জুন ২ লক্ষ ৫০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়। ১৯ জুন বাকখালী নদী, মহেশখালী চ্যানেল, ও নাজিরার টেক এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে চারটি বেহুন্দি জাল জব্দ করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অবৈধভাবে সাগরে মাছ ধরার অপরাধের ৬টি মামলা, একজনের একমাসের জেল, ৩ লক্ষ ১ হাজার টাকা জরিমানা ও ১৫ টি নৌযান আটক করা হয়।

মেরিন ফিসারিজ অফিসার (এমএফও) মো. আ কুদ্দুস বলেন, ‘গত ২০ মে থেকে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। এই সময়ে সাগরে সব ধরনের যান্ত্রিক অযান্ত্রিক নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ থাকবে। কিন্তু অনেকেই এই আদেশ অমান্য করে নিষিদ্ধ জাল দিয়ে মাছ শিকার করছে। এতে করে সাগরে বসবাসরত অনেক জীববৈচিত্র্য মারা পড়ছে। এছাড়া মাছের পোনা, ডিমের ক্ষতি হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা শুরু থেকে আমরা অভিযান অব্যাহত রেখেছি। এ পর্যন্ত ৬টি অভিযান চালিয়েছি। যেখানে লক্ষ লক্ষ মিটার কারেন্ট জাল, বেহুন্দি ও চরঘেরা জাল জব্দ করতে সক্ষম হয়েছি। যেগুলো জনসম্মুখে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘গত গত শনিবার ১ লক্ষ ৫০ হাজার মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করেছি। এর আগে ৫ জুলাই ৩ লক্ষ ৯০ হাজার মিটার কারেন্ট ও চরঘেরা জাল জব্দ করা হয়েছে। ৭টি নৌযানকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। আইন অমান্য করে মাছ ধরবে তা হতে দেওয়া যাবেনা’।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ বদরুজ্জামান বলেন, ‘সকল প্রকার নি‌ষিদ্ধ ‘কারেন্ট জাল ও চায়না জাল দিয়ে মাছ শিকার করা বেআইনি কাজ’। ‘মাছ শিকা‌রে নি‌ষিদ্ধ জাল ব‌্যবহার না করার জন‌্য প্রচার প্রচারণা চলমান র‌য়ে‌ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘চায়না জাল মাছের জন্য খুবই ভয়ংকর। চায়না জাল দিয়ে মাছ ধরলে কিছুদিন পর নদীতে আর কোনো মাছ পাওয়া যাবে না। এখনই এই কা‌রেন্ট জাল ও চায়না জা‌লের বিরু‌দ্ধে ব‌্যবস্থা নেওয়া জরুরি। শুধু মাছ-ই নয়’ নদীতে থাকা কোনো জলজ প্রাণীও রক্ষা পাচ্ছে না। এমন কী মাছের ডিমও ছেঁকে তোলা হয় চায়না জাল দিয়ে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে চিংড়ি, পুঁটি, রুই-কাতলা, টেংরা, কই, শিং, মাগুর, তেলাপিয়া, বেলে, বোয়াল, শোল, টাকি থেকে শুরু করে ছোট বড় কোন মাছই রেহাই পাচ্ছে না এই নিষিদ্ধ জাল থেকে। মা‌ছের সঙ্গে বি‌ভিন্ন ধর‌নের কাঁকড়া, কচ্ছপ, কু‌চিয়া, বি‌ভিন্ন প্রজা‌তির সাপ ছাড়াও পা‌নি‌তে বাস করা বি‌ভিন্ন প্রজা‌তির উপকা‌রি পোকামাকড় ও জা‌লে আট‌কে যা‌চ্ছে, ডাঙ্গায় তু‌লে এসব প্রাণী ও পোকা মাকড় মে‌রে ফে‌লছে মাছ শিকারিরা।’

বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনায় ১৭ বছর আগে ২০০২ সালে সংশোধিত মৎস্য সংরক্ষণ আইনে কারেন্ট জাল উৎপাদন, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন হাট বাজারে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ চায়না ( কারেন্ট) জাল। নিষিদ্ধে আইন হলেও অবাধে চলছে বিক্রি। প্রতিদিন কারেন্ট জাল বিক্রি হচ্ছে। তবে, এক্ষেত্রে বর্ষা মৌসুমে এর ব্যবহার বেশি হয়ে থাকে। এসব জাল দিয়ে জেলেরা বিভিন্ন নদ-নদী ও খাল-বিলে দেশি প্রজাতির ডিমওয়ালা ও পোনা মাছ নিধন করছেন। বর্ষার সময় এর ব্যবহার অনেকগুণ বেড়ে যায়। বন্যা ও বৃষ্টির পানি নানার সাথে সাথে জালের ব্যবহার আরও বৃদ্ধি পায়।

মৎস্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, ‘অবৈধ জালের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করার দায়িত্ব মৎস্য অফিসের। প্রকাশ্যে কারেন্ট জাল বিক্রি হচ্ছে। তারা কি করছেন। অভিযানে যেসব আটক করা হচ্ছে, সেগুলো বাজার থেকে কেনা হচ্ছে। সাগরে অভিযানের পাশাপাশি বিভিন্ন হাট-বাজারে অভিযান চালালে এগুলো বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু তারা তা না করে লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিচ্ছে, তেমনি আইন অমান্য করতে সাহায্য করছে। এমনিতেই নানা কারণে আমাদের বহু প্রজাতির মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। তার ওপর যদি কারেন্ট জাল দিয়ে এভাবে অবাধে মাছ ধরা হয়, তাহলে আরও অনেক প্রজাতির মাছ যে অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।’

মানুষের দেহের আমিষের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পূরণ হয় মাছ থেকে। তাই মৎস্য সম্পদ যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং উৎপাদন না বাড়িয়ে কোনো উপায় নেই। মৎস্য খাতের ভবিষ্যতের স্বার্থেই কারেন্ট জালের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারের মৎস্য অধিদপ্তরকে নিয়মিত অভিযান ও প্রচার-প্রচারণা চালানোর উদ্যোগ নিতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাঠকের মতামত: