ঢাকা,বুধবার, ১৫ মে ২০২৪

পৌরকাউন্সিলরের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ ভুক্তভোগীদের

চকরিয়ায় আদালতের উচ্ছেদ অভিযানের ঘন্টা না পেরোতেই ফের দখল হিন্দু পরিবারের জায়গা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া :: কক্সবাজারের চকরিয়া পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের দিগরপানখালী মৌজার বেদখল হওয়া পৈতৃক ১০ শতাংশ জমি ফিরে পেতে ২০০৮ সালে আদালতে মামলা করেন প্রয়াত মনিন্দ্র লাল দাশের চার পুত্র পেঠান দাশ, হারাধন দাশ, প্রেমধন দাশ ও সাধন দাশ। ২০১৮ সালে সেই মামলায় তারা রায় পান। এর পর আরেকটি মামলা করা হয় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের। সেই মামলার রায় শেষে আদালত নির্দেশ দেয় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বাদীপক্ষকে জায়গা বুঝিয়ে দিতে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সেই আদেশ মোতাবেক হারাধন দাশ গংয়ের বেদখলীয় জায়গা দখলমুক্ত করা হয় গত বৃহস্পতিবার। তবে এর আগে আদালতের কর্মকর্তারা পুলিশ ও উকিল কমিশনের সহায়তায় উচ্ছেদ অভিযানে গেলে দখলবাজদের পক্ষ নিয়ে ব্যাপক বাঁধা দেন স্থানীয় পৌরকাউন্সিলর বেলাল উদ্দিন। এ সময় আদালতের কর্মকর্তা (নাজির) দেবু গুপ্ত, উকিল কমিশন এবং পুলিশ কাউন্সিলর বেলালকে অনেক বুঝানোর চেষ্টাও করেন। কিন্তু কাউন্সিলর বেলাল প্রকাশ্যে বলতে থাকেন, এখানে কিসের আদালত? দুইপক্ষকে নিয়ে বসে আমি এই বিষয়ে সমাধান দেবো, আমি এলাকার জনপ্রতিনিধি। এই অবস্থায় সেখানে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গনির নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ফোর্স গিয়ে কাউন্সিলর বেলাল ও অবৈধ দখলদারকে আদালতের রায় এবং নির্দেশনার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়ার পর পরিস্থিতি অভিযানকারীদের অনুকূলে আসলে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়। সেই উচ্ছেদ কার্যক্রম চলে সন্ধ্যার পরও।
হারাধন দাশসহ ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, চকরিয়া সহকারী জজ আদালতের রায় এবং নির্দেশনা মোতাবেক বৃহস্পতিবার লাল পতাকা উঁচিয়ে দিয়ে তাদের জায়গা থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে আদালত। কিন্তু অভিযান শেষ করে আদালতের কর্মকর্তা এবং পুলিশ ঘটনাস্থল ত্যাগ করার এক ঘন্টা পর ফের ওই জায়গার নিয়ন্ত্রণ নেয় দখলবাজরা। এ সময় তাদের বাড়ি (নির্মাণাধীন পাকা বাড়ি) এবং বাউন্ডারি দেওয়ালও ভাঙচুর চালায়। এ সময় বাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মিটার খুলে নেওয়াসহ বিপুল পরিমাণ রডও লুট করে তারা। এমনকি উচ্ছেদের কারণে পরিবার সদস্যদের ওপরও আক্রমণের চেষ্টা চালায় দখলবাজরা। এতে প্রাণভয়ে সন্তান-সন্ততি নিয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে পৌরশহরের চিরিঙ্গায় নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন গত দুইদিন ধরে।
হারাধনের ছোট ভাই প্রেমধন জানান, আদালতের রায় এবং নির্দেশনা মোতাবেক আমাদের জায়গা থেকে দখলবাজদের উচ্ছেদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে পৌরকাউন্সিলর বেলাল। অভিযান শেষ হওয়ার পর পরই দখলবাজদের পক্ষ নিয়ে সশস্ত্র সন্ত্রাসী জড়ো করে ফের জায়গাটি দখলে নেয়। এমনকি ওই জায়গার পাশে পৈতৃক ভিটায় আমাদের নির্মাণাধীণ বাড়ি এবং বাউন্ডারি দেওয়ালেও ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এই ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতেই থানায় কাউন্সিলর বেলাল উদ্দিনসহ দখলবাজদের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরী রুজু করা হয়েছে। এর পর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. মাঈনউদ্দিনের নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে গেলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশ চলে আসার পর ফের আমাদের জায়গা ও নির্মাণাধীণ বাড়িতে সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র পাহারা বসিয়েছে। এই অবস্থায় চার ভাইয়ের পরিবার সদস্যরা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছি।
মামলার বাদী ভুক্তভোগী হারাধন দাশ অভিযোগ করেছেন, স্থানীয় বেলাল উদ্দিন কয়েকমাস আগে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আমাদের কাছ থেকে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করে। সেই চাঁদা দিতে না পারায় দখলবাজদের পক্ষ নিয়ে আদালতের উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রমকে প্রথমে বাঁধা দেয়। যা উপস্থিত আদালতের কর্মকর্তা, উকিল কমিশন, পুলিশসহ স্থানীয় লোকজন প্রত্য করেছেন। এর পর উচ্ছেদ শেষে রাতে পুনরায় সেই জায়গা দখলেও নেতৃত্ব দেন বেলাল উদ্দিন। বর্তমানে সেখানে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণের তোড়জোড় এবং সেখানে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের দ্বারা পাহারা বসানো হয়েছে। এই অবস্থায় আমাদের নির্মাণাধীন বাড়িতেও যেতে পারছি না। টিনের ঘেরা দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে চলাচল পথও।
উচ্ছেদ অভিযান কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োগপ্রাপ্ত চকরিয়া সহকারী জজ আদালতের নাজির দেবু গুপ্ত জানান, অভিযানের সময় পৌরকাউন্সিলর বেলাল উদ্দিন বাঁধা দেওয়ার বিষয়টি আমাদের সহকারী জজ স্যারকে মুঠোফোনে অবহিত করা হয়। একইসময় থানার ওসিকেও বিষয়টি অবহিত করার পর তিনি দ্রুত অভিযানস্থলে হাজির হন। এর পর উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু করা হয়।
এই ব্যাপারে চকরিয়া থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গনি বলেন, ‘আদালতের রায় এবং নির্দেশে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনায় গিয়ে আদালতের কর্মকর্তা এবং পুলিশ সদস্যরা বাধার শিকার হলে তাৎক্ষণিক সেখানে ছুটে যাই। এর পর দখলবাজদের বোঝানোর পর তারা সেখান থেকে সরে গেলে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় স্থানীয় কাউন্সিলর বেলাল উদ্দিনকে সতর্ক করা হয় আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিতে। এর পর সে আর ঝামেলা করেননি।’
ওসি আরো বলেন, ‘অভিযান শেষে ফের দখল এবং নির্মাণাধীন বাড়িতে হামলার অভিযোগে ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য প্রেমধন দাশ বাদী হয়ে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) রুজু করেছেন। জিডিতে কাউন্সিলর বেলাল উদ্দিনকে এক নম্বর বিবাদী করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্তের জন্য একজন অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পরিবারটি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’
গত বৃহস্পতিবার উচ্ছেদ কার্যক্রম চলাকালীন বাঁধা প্রদান প্রসঙ্গে পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বেলাল উদ্দিন দাবি করেন, যেসব পরিবারকে জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তারা সরকারী খাস জায়গায় বসতি গড়েছিলেন। আগে কোন ধরণের নোটিশ না দিয়ে উচ্ছেদ করতে গেলে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমি সংশ্লিষ্টদের নিকট আসল বিষয় তিনি জানতে চেয়েছেন।
পুনরায় দখলে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে কাউন্সিলর বেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি এই বিষয়ে কিছুই জানি না। আমি কারো কাছ থেকে চাঁদাও চাইনি।’

পাঠকের মতামত: