এম.শাহজাহান চৌধুরী শাহীন ॥
কক্সবাজারের রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নের পশ্চিম গোয়ালিয়াপালং এলাকায় চাঞ্চল্যকর গৃহবধু ও গৃহপরিচারিকা খুনের ঘটনায় দায়ের করা মামলার অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেছেন নিহত তাহমিনা কবির জাকির পিতা ও মামলার বাদী নুরুল কবির।
নিহতের পিতার অভিযোগ তদন্তকারী সিআইডির উপ-পরিদর্শক মোঃ শাকের আলম বাদী ও স্বাক্ষীর বক্তব্য নেয়নি। এমনকি ঘটনায় সন্দিগ্ধ আসামীদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমুলক কোন জবানবন্দিও আদায় করতে পারেনি। অভিযোগপত্রে যাদের স্বাক্ষী বানানো হয়েছে তারা ওই তদন্তকারীর বানানো বলে দাবী করা হয়। গত সোমবার ১ ফেব্রুয়ারী সকালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত নং-১ (রামু) কক্সবাজার আদালতে এই নারাজির আবেদন করেন। পরবর্তী শুনানি ২ মার্চ নির্ধারণ করেছেন আদালত।
কোর্ট পুলিশ পরিদর্শক জানান, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত নং-১ (রামু-কক্সবাজার) ডাবল খুন মামলার শুনানির নির্ধারিত ধার্য তারিখ ছিল সোমবার। বাদী পক্ষ নিহত তাহমিনা কবির জাকির পিতা নুরুল কবির অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেছেন। এরপর মামলার পরবর্তী শুনানি ২ মার্চ নির্ধারণ করেছেন আদালত। গত সোমবার শুনানি শেষে এই দিন ধার্য করা হয়।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০১৪ সালের ৮ অক্টোবর বিকাল ৩টার পূর্বে যে কোন সময় রামু উপজেলার খুনিয়াপালং ইউনিয়নে পশ্চিম গোয়ালিয়ার মোহাম্মদ ইউনুছের ছেলে প্রবাস ফেরৎ মোহাম্মদ রিদুয়ানের স্ত্রী তাহমিনা কবির জাকি (২৫) ও গৃহপরিচালিকা খুরশিদা বেগমকে জবাই করে হত্যা করা হয়। দুই জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গৃহবধুর স্বামী মোহাম্মদ রিদুয়ানকে আটক করে পুলিশ। হত্যায় ব্যবহৃত দা আদালমত হিসেবে উদ্ধার করা হয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, প্রথমে গৃহবধু তাহমিনা কবির জাকিকে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যার ঘটনাটি দেখে ফেলেন গৃহপরিচারিকা খুরশিদা বেগম। পরে হত্যাকারীরা ধাওয়া করে বাহির থেকে ধরে এনে গৃহপরিচারিকাকেও একই কায়দায় হত্যা করা হয়।
নিহত মোহাম্মদ রিদুয়ানের স্ত্রী তাহমিনা কবির জাকি (২৫) একই ইউনিয়নের ধোয়াপালং গ্রামের নুরুল কবিরের কন্যা ও গৃহ-পরিচালিকা খুরশিদা বেগম (১০) ওই এলাকার সিরাজুল ইসলামের কন্যা।
স্থানীয় লোকজনের সন্দেহের ভিত্তিতে পুলিশ রিদুয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে। হত্যাকারীরা নিহত জাকির ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি লুট করে নিয়ে যান।
এঘটনায় নিহত গৃহবধুর পিতা নুরুল কবির বাদী হয়ে রামু থানার মামলা নং-১৯, জিআর-৩০৭/১৪,তাং-৯/৯/২০১৪ইং। ধারা-নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০(সংশোধিত ২০০৩) এর ১১ (ক) তৎসহ ৩০২ দঃবিধি। মামলাটি তদন্তের জন্য রামু থানার এসআই আতিকুর রহমানকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে আটক স্বামী রিদুয়ানকে পুলিশী রিমান্ডে আনা হয়। এছাড়া মামলার তদন্ত কালে উখিয়া রুমখা পালং এলাকার কবির আহমদের ছেলে দেলোয়ারের নিকট থেকে ওই নিহত জাকির ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি উদ্ধার ও তাকে গ্রেফতার করে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই আতিকুর রহমান।
এদিকে, চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের মামলাটি সিআইডি তফশীলভুক্ত হওয়ায় ২০১৪ সালে ১৯ নভেম্বর মামলাটি সিআইডি উপ-পরির্দশক মোঃ শাকেরুল আলমকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি ঘটনার তদন্ত চালান।
অপরদিকে, এঘটনায় জড়িত খুনিয়াপালং ইউনিয়নের পশ্চিমগোয়ালিয়া গ্রামের হাজী আমান উল্লাহর মেয়ে ঝিনু আকতার, রুমখাপালং গ্রামের কবির আহমদের ছেলে দেলোয়ার, পশ্চিম গোয়ালিয়ার মৃত হাজী মোঃ শফির ছেলে হাজী আমান উল্লাহ, নুরুল আমিনের ছেলে মোঃ শাহীন, ছৈয়দ হোসেন ও নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুনধুম শীলপাড়ার হরিসাধন বড়–য়ার ছেলে দানেশ বড়–য়াকে অভিযুক্ত করে তাদেরকে আটকপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ করতঃ বিচারের আওতায় আনার জন্য তদন্তকারী কর্মকর্তাকে নির্দেশের আবেদন জানিয়ে ২০১৪ সালের ২৯ নভেম্বর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদাল নং-১ (রামু) কক্সবাজার এর নিকট একটি দরখাস্ত দাখিল করেন বাদী। বিজ্ঞ আদালত তদন্তের স্বার্থে তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট তা প্রেরণ করে।
মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি উপ-পরিদর্শক মোঃ শাকেরুল আলম গত ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর ( মোঃ রিদুয়ান, ঝিনুয়ারা বেগম ও দেলোয়ার হোসন) তিন জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র নং-৩৩৩ আদালতে দায়ের করেন।
মামলা বাদী নুরুল কবির বলেন, “যারা আমার কন্যাকে হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ও যাদের আসামি করে আদালতে গত বছরের ২৯ নভেম্বর আদালতে ৬ জনকে অভিযুক্ত করে একটি দরখাস্ত দায়ের করেছিলাম। উক্ত দরখাস্তখানা বিজ্ঞ আদালত তদন্তের স্বার্থে তদন্তকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করেন।
কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা উক্ত বিষয় আমলে না নিয়ে আসামীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে বশীভুত হয়ে একটি যোগসাজশী অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা । তদন্তকারী কর্মকর্তার দাখিলীয় প্রতিবেদন নিয়ে আমি ক্ষুব্ধ। আমি মনে করি এই মামলায় অনেক কিছু গোপন রাখা হয়েছে।
তিনি নারাজি দরখাস্তে সৃনিদৃষ্ট ৭টি কারণ ও বিষয় উল্লেখ করে আবেদন করেন। সাতটি কারণের মধ্যে রয়েছে, বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে শোনা কথায় ও অনুমানের উপর ওই মামলাটি দায়ের করেন। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সুত্র, ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ও স্থানীয় স্বাক্ষীদের মাধ্যমে জানতে পারেন ঘটনার সময় তার কন্যার স্বামী ও মামলার আসামী রিদুয়ান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না ও বাজারে ছিলেন। এছাড়া বাদীর মেয়ের জামাই রিদুয়ান ঘটনার পূর্বে প্রবাস থেকে আসার সময় নিহত জাকির জন্য বেশ কিছু স্বর্ণালংকার আনেন। উক্ত স্বর্ণালংকারগুলো দেখে লোভাতুর হয়ে এবং ঝিনু আকতার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া বাহনা দিয়ে স্বর্ণালংকার ধার নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর ফলশ্রুতিতে ক্ষুদ্ধ হয়ে ঝিনু আকতার সহ তার সহযোগী অপরাপর আরো ৫ জন যোগসাজশ করে তার মেয়ে জাকিসহ দুই জনকে হত্যা করেন। এছাড়া ওই ৬জন আসামীকে যথাযত তদন্তক্রমে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে খুনের আসল রহস্য উদঘাটন হবে বলে দাবী করা হয়।
বাদী নুরুল কবির বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা বাদী ও স্বাক্ষীর বক্তব্য নেয়নি। শুধু একবার ঘটনাস্থলে ঘর ডাকাতির ঘটনা তদন্তে গিয়েছিলেন। পরে আর কোন ঘটনাস্থল পরির্দশন করেনি। সন্দিগ্ধ আসামীদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমুলক কোন জবানবন্দি নিতে পারেনি তিনি। অভিযোগপত্রে যাদের স্বাক্ষী বানানো হয়েছে তারা ওই তদন্তকারী কর্মকর্তার বানানো ও তৈরি করা।
অভিযোগপত্রের বিবরণ সম্পূর্ণ আগোচালো। রহস্যজনক কারণে আদালতে নেয়া হয়নি অভিযুক্তদের জবানবন্দি, রিমান্ডও চায়নি সিআইডি পুলিশ।
তিনি দাবী করেন, কন্যা জাকি সহ দুই জন খুনের প্রকৃত ঘটনার তথ্য বের করতে ব্যর্থ হন তদন্তকারী কর্মকর্তা। একারণে আমি (পিতা) মামলার বাদী চাঞ্চল্যকর ডাবল মার্ডারের মতো একটি ন্যাক্কার জনক ঘটনার ন্যায় বিচার হতে বঞ্চিত হওয়ার আশংকা ছাড়াও প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখছি। চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের মামলার দাখিল করা অভিযোগপত্র সন্তুষ্ট হতে পারিনি। অভিযোগপত্র প্রশ্নবিদ্ধ থাকায় আমি আদালতে নারাজি দিয়েছি।”
মামলার বাদী সাংবাদিকদের বলেন, “২০১৪ সালে সংগঠিত জোড়া খুনে যারা পরিকল্পনাকারী, তাদেরও বের করা হোক ।”
পাঠকের মতামত: