ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

রাখাইনে ফেরা রোহিঙ্গাদের নির্যাতন করছে মিয়ানমার: এইচআরডব্লিউ

ডেস্ক রিপোর্ট ::

মার্কিন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এইআরডব্লিউ অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশ থেকে রাখাইনে ফেরা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এতে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে দেওয়া মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতির সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করছে ওই সংস্থা। নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এইচআরডব্লিউ বলছে, নির্যাতনের এই আলামত প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্তি ও জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানের অপরিহার্যতাকে সামনে এনেছে।

গত বছরের ২৫ আগস্ট নিরাপত্তা চৌকিতে আরসার হামলাকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানের কারণ বলা হলেও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দিতে এবং তাদের ফেরার সমস্ত পথ বন্ধ করতে আরসার হামলার আগে থেকেই পরিকল্পিত সেনা-অভিযান শুরু হয়েছিল। চলমান জাতিগত নিধনে হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রায় ৭ লাখ মানুষ। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বিপুল পরিমাণ শরণার্থীকে ফিরিয়ে নিতে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে প্রত্যাবাসন চুক্তি করতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। তবে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে সেই প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। অবশ্য এইচআরডব্লিউ তাদের প্রতিবেদনে ৬ রোহিঙ্গার প্রসঙ্গ তুলে এনেছে যারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসার পর আবারও মিয়ানমারে ঢুকেছিল। রাখাইনে থেকে যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা ছিল না তাদের। টাকা উপার্জন করে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসার কথা চিন্তা করেছিল তারা। ওই ৬ রোহিঙ্গা এইচআরডব্লিউ-এর কাছে অভিযোগ করেছে, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হয়। অবৈধভাবে সীমান্ত পার হওয়ার অভিযোগে ৪ বছর করে কারাদণ্ডও দেওয়া হয় তাদের।

২০১৬ সালে অং সান সু চি ডি ফ্যাক্টো সরকারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পর ওই বছরের জুনে মিয়ানমারে সফর করে কফি আনান ফাউন্ডেশন। সেসময় আনান সু চি’র অনুরোধে সাড়া দেন, যার ফলশ্রুতিতে রাখাইন কমিশন গঠিত হয়। গত বছরের ২৪ আগস্ট কমিশনের কার্যকাল শেষে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। রাখাইন সংকট নিরসনে ৮৮টি সুপারিশ হাজির করা হয় আনান কমিশনের পক্ষ থেকে, যার অন্যতম ছিল বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দ্রুততর-স্বেচ্ছামূলক-মর্যাদাপূর্ণ-নিরাপদ প্রত্যাবাসন। তবে মিয়ানমার শুরু থেকেই প্রত্যাবাসনের ভান করে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মিয়ানমার-বাংলাদেশ প্রত্যাবাসন চুক্তি অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাখাইনে প্রস্তুত করা হয়েছে ট্রানজিট ক্যাম্প। চলতি বছরের জুনের প্রথম দিনে ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক অনুসন্ধানে জানা যায়, সেই ক্যাম্পে মিয়ানমারের অভিবাসন কর্মকর্তারা যেমন আছেন, সাংবাদিকরাও আসছেন প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত প্রতিবেদনের খোঁজে। তবে চুক্তি অনুযায়ী যাদের বাংলাদেশ থেকে ফিরবার কথা, সেই রোহিঙ্গাদেরই কেবল দেখা মেলে না।

‘ফিরে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা মিয়ানমার সরকারের নিরাপদ ও সুরক্ষিত শরণার্থী প্রত্যাবাসনের প্রতিশ্রুতিকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে’; বলেছেন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার মুখে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে চাইলেও, বাস্তবতা হলো যে কারণে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, রাখাইনে ফিরতে গেলেও তাদের আগের মতোই সেই নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতে হবে। এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, সাজা ঘোষণার এক মাসের মাথায় অন্য অনেকের সঙ্গে ওই ছয় রোহিঙ্গাকেও ‘ক্ষমা’ করে দেওয়ার ঘোষণা দেয় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। ১ জুন, মিয়ানমার সফরকারী বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয় তাদের। এইচআরডব্লিউ-এর দাবি, প্রত্যাবাসনে নিজেদের অঙ্গীকার প্রমাণেই এমন ছল-চাতুরির আশ্রয় নিয়েছিল তারা। ওই ছয় রোহিঙ্গা পরে আবারও বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে পরামর্শ দেওয়ার জন্য সু চির পক্ষ থেকে এক পর্যায়ে ‘কমিটি ফর ইমপ্লিমেন্টেশন অব দ্য রিকোমেনডেশন অন রাখাইন স্টেট’ নামের আন্তর্জাতিক প্যানেল গঠন করা হলেও তার নিরপেক্ষতা ভয়ঙ্করভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে চলতি বছর মে মাসেই মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে রাখাইনের ঘটনা তদন্তে নতুন কমিশন গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। জুলাইয়ে ফিলিপাইনের কূটনীতিক রোজারিও মানালোর নেতৃত্বাধীন কমিটির চার সদস্যের নাম ঘোষণা করা হয়। তবে নতুন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রতি সুবিচার নিশ্চিত হবে; এমনটা ভাবতে নারাজ বিশ্লেষকরা।

এইচআরডব্লিউ-কে সাক্ষাৎকার দিয়েছে রাখাইনে ফিরে নির্যাতনের কবলে পড়া ওই ৬ রোহিঙ্গা। এদের মধ্যে ৩ জন পূর্ণাঙ্গ বয়সের তরুণ। অপর তিনজন কিশোর, যাদের মধ্যে সবথেকে ছোট কিশোরের বয়স ১৬। মংডু জেলার ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে তাদের আটক করা হয়েছিল। তারা জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় সার্বক্ষণিক তাদের দিকে বন্দুকের নল তাঁক করে রেখেছিল মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি-আরসার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে, এমন স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করতে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। জিজ্ঞাসাবাদে মিয়ানমারের সেনা-গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা লোহার রড কিংবা লাঠি দিয়ে তাদের ব্যাপক মারধোর করে, তাদের ইলেকট্রিক শক দেওয়া হয়, শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়িয়ে দেওয়াসহ নানান ধারার নির্যাতন চালায়। সে সময় প্রয়োজনীয় খাবার ও পানীয় পানিও দেওয়া হয়নি তাদের। ওই ছয় রোহিঙ্গা এইচআরডব্লিউ-কে জানায়, জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের বিচারপূর্ববর্তী বিভিন্ন আটককেন্দ্রে নেওয়া হয়। সেইসব আটককেন্দ্রে তাদের রাখা হয় বিপন্ন অবস্থায়। তাদের জন্য সেখানে কোনও আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শের সুযোগ ছিল না। বিচারিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলা হচ্ছিলো বার্মিজ ভাষায়, যা তাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয়। এক পর্যায়ে প্রত্যেককে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তাদের বুথিডং কারাগারে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে আরও শত শত রোহিঙ্গা বন্দি আটক রয়েছে। ২৩ মে মংডুর জেলাপ্রশাসক সারিবদ্ধভাবে বেশকিছু রোহিঙ্গা-বন্দিকে দাঁড় করিয়ে ঘোষণা দেন, প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। অচিরেই তাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) সরবরাহ করা হবে এবং মুক্তি দেওয়া হবে। ২৭ মে তারিখে রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চির দফতর থেকে নিশ্চিত করা হয়, ৫৮ জন রোহিঙ্গা বন্দিকে মুক্তি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। পরে আরও চার বন্দিকে এই তালিকায় যুক্ত করা হয়।

কর্তৃপক্ষ ওই ৬২ রোহিঙ্গাকে এক পর্যায়ে নাগা খু ইয়া গ্রামের বিজিবি কম্পাউন্ডে নিয়ে যায়। তাদেরকে এনভিসি কার্ড নিতে বাধ্য করা হয় এবং হুমকি দেওয়া হয় কম্পাউন্ড ছেড়ে গেলে তাদের আবার আটক করা হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ি তাদের ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণ আর মানবিক সহায়তায় টাকা দেওয়ার লোভ দেখান। পরে তাদের একটি ট্রানজিট ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে ১ জুন তারিখে সরকারি তত্ত্বাবধানে আনা মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে হাজির করা হয় তাদের। সাক্ষাৎকার দেওয়া ৬ রোহিঙ্গা এইচআরডব্লিউ-কে জানান, মিডিয়ার সামনে কী বলতে হবে তা নিয়ে আগেই তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এদের মধ্যে একজন কিশোর এইচআরডব্লিউকে বলেছে, ওই নির্দেশনার বাইরে কিছু বলতে যাচ্ছিল সে, সঙ্গে সঙ্গে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। মিডিয়া সংস্থাগুলো চলে যাওয়ার পর তাদের হুমকি দেওয়া হয়, তারা যেন ট্রানজিট ক্যাম্প ত্যাগ না করে। রাখাইনে থাকলে আবারও আটক হওয়ার ভয় রয়েছে বলে তারা আবার বাংলাদেশে পালিয়ে আসে।
রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা সু চির দফতরের মহাপরিচালক ও মুখপাত্র জ হুতাইকে বারবার টেলিফোন করেও এ ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া পায়নি এইচআরডব্লিউ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসন ওই ৬২ রোহিঙ্গার প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, রোহিঙ্গাদের এই বিপন্নতা তাদের জন্য একটি সতর্কতামূলক আলামত, যারা বিশ্বাস করে যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমারের অবস্থান ইতিবাচক। তিনি বলেন, স্বেচ্ছামূলক-নিরাপদ-মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে যে প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার, মিয়ানমার তার থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকলেও মিয়ানমার তাদের নাগরিক বলে স্বীকার করে না। উগ্র বৌদ্ধবাদকে ব্যবহার করে সেখানকার সেনাবাহিনী ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্থাপন করেছে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের চিহ্ন। ছড়িয়েছে বিদ্বেষ। ৮২-তে প্রণীত নাগরিকত্ব আইনে পরিচয়হীনতার কাল শুরু হয় রোহিঙ্গাদের। এরপর কখনও মলিন হয়ে যাওয়া কোনও নিবন্ধনপত্র, কখনও নীলচে সবুজ রঙের রশিদ, কখনও ভোটার স্বীকৃতির হোয়াইট কার্ড, কখনও আবার ‘ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড’ কিংবা এনভিসি নামের রং-বেরঙের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে। ধাপে ধাপে মলিন হয়েছে তাদের পরিচয়। ক্রমশ তাদের রূপান্তরিত করা হয়েছে রাষ্ট্রহীন বেনাগরিকে। রোহিঙ্গাদের পরিচয় এখন একটাই: পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন শরণার্থী জনগোষ্ঠী।

পাঠকের মতামত: