ডেস্ক নিউজ : সারা দেশে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালানোর পাশাপাশি তাদের মদদদাতাদেরও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে। ঢাকাসহ সারা দেশে ২১৩ জন পুলিশ সদস্য মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার তথ্য পেয়েছে পুলিশের গোয়েন্দা শাখাগুলো এবং তালিকার সংখ্যাটি আরো বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন।
অভিযুক্তদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর, আশুগঞ্জ ও আখাউড়া, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা (সাবেক), খুলনার ফুলতলা ও দীঘলিয়া থানার ওসিও রয়েছেন। পুলিশের ঊর্ধ্বতন সূত্র মতে, যাদের নাম এসেছে তাদের নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। মাদক কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতিমধ্যে সিআইডি পুলিশ নারায়ণগঞ্জ থেকে তিন পুলিশ সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছে। অভিযুক্ত ওসিদের কয়েকজন কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ষড়যন্ত্র থেকে তাঁদের নাম তালিকায় আনা হয়েছে।সূত্র জানায়, পুলিশের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠায় এখন কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।
ইতিমধ্যে পুলিশের সব কটি রেঞ্জের ডিআইজি ও পুলিশ সুপারদের কাছে নানা দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, কয়েকজন অ্যাডিশনাল এসপির কর্মকাণ্ডও আমরা নজরদারি করছি। তারাও মাদক কারবারিদের সহায়তা করার অভিযোগ আছে। এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, পুুলিশের যেসব সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের গ্রেপ্তারের পাশাপাশি দৃষ্টান্তমূলক দেওয়া হবে।
গোয়েন্দাদের তৈরি তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, কিছু জায়গায় পুলিশের পাশাপাশি মাদকদ্রব নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শকরাও মাদক কারবারিদের মদদ দিচ্ছেন।
তালিকায় কারা : মাদক কারবারিদের সঙ্গে যেসব পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যের পৃষ্ঠপোষক বা সহায়তা করার অভিযোগ উঠেছে তাঁদের মধ্যে আছেন বিজয়নগর থানার ওসি আলী আরশাদ, ইন্সপেক্টর (তদন্ত) কবির হোসেন, আশুগঞ্জ থানার ওসি বদরুল আলম তালুকদার ও ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মেজবাহ উদ্দিন, আখাউড়া থানার ওসি মোশারফ হোসেন তরফদার, এসআই আবদুল আহাদ, ছাদেক মিয়া, কামরুল হাসান, আমজাদ হোসেন, মোমেন মিয়া ও মানিক মিয়া, কসবা থানার এসআই মুজিবুর রহমান-১, এসআই মুজিবুর রহমান-৩, সোহেল শিকদার ও মনির হোসেন-২ ও আশুগঞ্জ টোলপ্লাজার এসআই আবুল কালাম।
তালিকায় আরো আছেন রংপুর পার্কের মোড় পুলিশ ফাঁড়ির এসআই এরশাদ, রংপুরের কোতোয়ালি থানার এসআই ওয়ালিয়ার রহমান, এসআই হারেছ শিকদার, তরিকুল ইসলাম ও মো. সেলিম, বদরগঞ্জ থানার এসআই জুলহাস, পীরগঞ্জের ভেণ্ডাবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির এসআই ওবাদুর রহমান, মিঠাপুকুর থানার এসআই শফিকুল ইসলাম ও মিলন মিয়া, লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার সাবেক ওসি রেজাউল করিম রেজা, ইন্সপেক্টর আবদুর রাজ্জাক, এসআই নুর আলম, জহুরুল হক ও মাহমুদ আলম, নাগেশ্বরী থানার এসআই মশিউর রহমান, ভূরুঙ্গামারী থানার এসআই ফারুক হোসেন, কনস্টেবল মোকাদ্দেস আলী, ডিবির ইন্সপেক্টর মাহফুজুর রহমান, কনস্টেবল আনোয়ার হোসেন, কুড়িগ্রাম সদর থানার এসআই আবু তালেব ও কামরুল ইসলাম, গাইবান্ধায় ডিবির এসআই আমিনুল ইসলাম, সদর থানার এসআই জামাল হোসেন ও সাদুল্লাপুর ধাপেরহাট পুলিশ ফাঁড়ির এসআই রেজাউল।
তালিকায় আরো আছেন খুলনার আইচগাতির এসআই জাহিদ, রূপসা থানার এএসআই রবিউল ইসলাম, দাকোপ থানার এএসআই সবুর হোসেন, পাইকগাছা থানার এসআই মমিন, কয়রা থানার এসআই ইকবাল ও আজম, ডুমুরিয়ার মাগুরঘোনা ক্যাম্পের এসআই নাহিদ হাসান ও রবিউল, দীঘলিয়া থানার ওসি হাবিবুর রহমান ও এসআই মধুসূদন, ফুলতলা থানার ওসি আসাদুজ্জামান, খানজাহান আলীর শিরোমনি থানার কনস্টেবল শহীদুল ইসলাম, আটরা পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল মো. মিজান, দৌলতপুর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই মিকাইল হাসান, দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা ফাঁড়ির মেহেদী হাসান, খালিশপুর থানার এসআই কানাই লাল মজুমদার ও এসআই নুরু, খুলনা সদর থানার এসআই শাহ আলম, মিলন কুমার, সুব্রত কুমার বাড়ৈ, আশরাফুল আলম, সোনাডাঙ্গা থানার এসআই সোবহান, এমদাদুল হক, নুরুজ্জামান, লবণচরা থানার এসআই বাবুল ইসলাম, মনজিল হাসান, আবদুল্লাহ আল মামুন, লবণচরা পুলিশ ফাঁড়ির এসআই ওসমান গনি, হরিণটানা থানার এএসআই রিপন মোল্লা, খানজাহান আলী থানার এসআই রাজ্জাক, ইলিয়াস ও সুমঙ্গল।
অস্বীকার : অভিযুক্তদের মধ্যে কয়েকজন ওসির সঙ্গে কথা হয়েছে। খুলনার ফুলতলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, ‘তালিকাটি সম্পর্কে আমি অবহিত আছি। তালিকায় নাম দেখে আশ্চর্যও হয়েছি। আমার থানা এলাকায় কোনো মাদকের রুট নেই। এলাকায় আপনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন—আমি মাদক বা চোরকারবারিদের সহায়তা করি কি না। এতটুকু বলতে পারি—সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পুলিশে চাকরি করছি। মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপি স্যারের নির্দেশে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। শত্রুতামূলকভাবে কোনো অশুভ চক্র তালিকায় আমার নামটি ঢুকিয়ে দিয়েছে বলে আমি মনে করি। ’
আশুগঞ্জ থানার ওসি বদরুল আলম তালুকদার বলেন, ‘চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট। এ থানায় ওসি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মাদকের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছি। কোনো মাদক কারবারির সঙ্গে আপস করি নাই—যা আমাদের বড় স্যারেরা জানেন। কাজের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে একটি গ্রুপ তালিবায় নাম জড়িয়ে দিয়েছে।
আখাউড়া থানার ওসি মোশারফ হোসেন তরফদার বলেন, তিনি আসার পর থেকে মাদক নির্মূলে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দুই শতাধিক মাদক কারবারিকে আত্মসমর্পণ করিয়েছেন। মাদক কারবারের সঙ্গে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।
একই কথা বলেছেন খুলনার দীঘলিয়া থানার সাব-ইন্সপেক্টর নাহিদ হাসান। তিনি বলেন, ‘পাঁচ-ছয় মাস আগে ডুমুরিয়ার মাগুরঘোনা পুলিশ ক্যাম্প থেকে বদলি হয়েছি। ওই ক্যাম্পে থাকাকালে মাদক উদ্ধার হওয়ার পর নিজেই ৭৭টি মামলার বাদী হয়েছি। তা হলে আপনিই বলেন, মাদক কারবারিদের কিভাবে সহায়তা করি?’ একটি চক্র ঈর্ষাবশে তাঁর নাম তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
মাদকের সঙ্গে পুলিশের জড়িত থাকার প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ চলছে। মাদক কারবারের সঙ্গে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্য জড়িত থাকলে তাদের কোমরে দড়ি বেঁধে হুড়হুড় করে টেনে আনা হবে। যে পদেই থাকুক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
রংপুর রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘মাদক কারবারিদের সঙ্গে যদি পুলিশের কোনো কর্মকর্তা বা সদস্য জড়িত থাকে তাহলে তাদের পুলিশে চাকরি করতে দেওয়া হবে না। ’
পাঠকের মতামত: