ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ভালো নেই বুনো হাতি, জঙ্গল থেকে ক্ষেত খাবার নেই কোথাও!

শাহীন মাহমুদ রাসেল :: কক্সবাজারে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, রোহিঙ্গা ও হাতির অভয়ারণ্য ধ্বংসের কারণে পাহাড় থেকে খাবারের খোঁজে লোকালয়ে এসে একের পর এক মারা পড়ছে বুনো হাতি। মৃত্যুর এই মিছিল যেন থামছেই না। সরকার কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বুনো হাতির মৃত্যুর তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশসচেতন কর্তাব্যক্তিরা। পাহাড়ি জনপদে বিচরণকারী হাতির সুরক্ষায় অভয়াশ্রম গড়ে তোলার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

শুধু চলতি মাসেই কক্সবাজার জেলায় ৩টি হাতি মারা গেছে। এ নিয়ে গত দুই বছরে মারা গেছে ১৪টি এশিয়ান বন্যহাতি। এ নিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর কর্মকর্তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গিয়ে হাতির আবাসস্থল উজাড়, চলাচলের করিডরে চরমভাবে বাধাগ্রস্থ ও খাদ্য সংকটে পড়েছে হাতিরা। প্রায় লোকালয়ে হানা দেয় বন্যহাতির দল। এ কারণে ফসল রক্ষায় বিদ্যুৎ শক ও গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে হাতি।

স্থানীয় অধিবাসী ও বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বনাঞ্চল উজাড় হওয়ায় বুনো হাতির খাবারের উৎস দিন দিন কমছে। এ ছাড়া বনে মানুষের বাস ও আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় হাতির ‘হোমরেঞ্জ’ (নিজস্ব বিচরণক্ষেত্র) কমে গেছে। এ জন্য হাতি খাবারের খোঁজে লোকালয়ে নেমে আসছে।

খাবার খুঁজতে খুঁজতে পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে নেমে এসে মানুষের বাধার মুখে পড়ে হাতির দল। বাধা পেয়েই তারা ফসলের মাঠ, মানুষের বসতঘরে তাণ্ডব চালায়। একপর্যায়ে হাতির দল বুনো আচরণ শুরু করে। কোনো কোনো সময় পায়ে পিষ্ট করে, কখনো শুঁড় পেঁচিয়ে তুলে আছাড় দিয়ে মানুষের জীবন কেড়ে নেয়। এই প্রেক্ষাপটে টিকে থাকার লড়াইয়ে নিজেদের জান-মাল রক্ষায় বুনো হাতির ওপর হিংস্র হয়ে ওঠে মানুষ।

এদিকে দেশের বিভিন্ন সীমান্তের ওপার থেকেও অনেক বুনো হাতি গুলিবিদ্ধ হয়ে এপারে এসে মারা পড়ছে। ওপারে বনের জমিতে বিভিন্ন ফসলের চাষাবাদের কারণে কোনো কোনো সময় হাতিকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার চোরা শিকারিরাও দাঁত, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লোভে বন্য হাতিকে হত্যা করে। এপারে এলাকাবাসী ক্ষেতের ফসল রক্ষায় বৈদ্যুতিক ফাঁদ তৈরি করছে। সেই বিদ্যুতের পাতা ফাঁদে পড়ে হাতির মৃত্যু ঘটছে। দুর্ঘটনায়ও মরছে হাতি।

বুনো হাতির মৃত্যুর পরের কাহিনী প্রায় একই গল্পে তৈরি। হাতির মরদেহ উদ্ধারের পর সেটির সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে বন বিভাগ ও পুলিশ। থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। প্রাণিসম্পদ বিভাগ ময়নাতদন্তের জন্য ফুসফুস, পাকস্থলীসহ কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংরক্ষণ করে। খাদ্যে বিষক্রিয়ায় মারা যেতে পারে। ময়নতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে।

বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন-২০১২ অনুযায়ী, বুনো হাতি হত্যা করলে দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। আর হাতির আক্রমণে নিহত হলে সরকারের তরফ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বন বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে এক লাখ টাকা এবং আহত হলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়ে থাকে। সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, হাতির আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষতিপূরণ পেলেও বুনো হাতি হত্যার ঘটনায় সাজার কোনো তথ্য নেই।

সংশ্লিষ্ট বন বিভাগের একাধিক সূত্রে জানা যায়, পাহাড়ে বনের জমি জবরদখল করে অবৈধ বসতি স্থাপন করার কারণে বুনো হাতির আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে। এতে পাহাড় ও বন ধ্বংসের পাশাপাশি হাতিসহ বন্য প্রাণীদের বিচরণক্ষেত্র ও চলাচলের পথ নষ্ট হচ্ছে। জবরদখলকারীরা বিভিন্নভাবে প্রভাবশালীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাওয়ায় তাদের উচ্ছেদও করা যাচ্ছে না। অবৈধ বসতি ও জবরদখলকারীদের উচ্ছেদ করা না গেলে এখানকার বন্য প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কঠিন হবে।

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ইদানীং বুনো হাতির চলাচলের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আগে ২৫-৩০টি হাতি একত্রে দল বেঁধে চলাফেরা করত। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, একটি-দুটি হাতি দলছুট হয়ে চলাফেরা করছে। এতে ঝুঁকি বাড়ছে।

পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কক্সবাজার জেলায় রয়েছে বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য। এই সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছিল বুনো হাতিসহ বিভিন্ন প্রাণীর নিরাপদ আবাস। কিন্তু গত ১০ বছরে এই আবাসস্থল ধ্বংসের অংশ হিসেবে গাছ কাটা, পাহাড় সাবাড় এবং সংরক্ষিত বন দখলে নিয়ে সেখানে স্থাপন করা হয়েছে অবৈধ ইটভাটা, শত শত বাড়িঘর। ফলে বনের নিরাপদ আবাস হারিয়ে হাতির পাল ঘন ঘন নেমে আসছে লোকালয়ে।

পরিবেশবাদী সংগঠন, বন বিভাগসহ স্থানীয় পরিবেশসচেতন মহলের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বন্য প্রাণী তথা বুনো হাতির আবাসস্থল একেবারেই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে কক্সবাজার জেলায়। এখানেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ আবাস ছিল বুনো হাতির। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় বনের ভেতরে গড়ে তোলেন অবৈধ ইটভাটা। মূলত এই অভয়ারণ্য ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর থেকেই প্রতিনিয়ত খাবারের খোঁজে হাতির দল নেমে আসা শুরু করে লোকালয়ে।

কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের উপপরিচালক নাজমুল হুদা জানিয়েছেন, কক্সবাজারে বিভিন্ন এলাকায় হাতি সহ বন্যপ্রাণী হত্যার বিষয়টি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। পাহাড় কাটাসহ বিভিন্ন মানব সৃষ্ট কারণে এসব হাতি ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস করা হচ্ছে অবিরত। ফলে তাদের খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। পাহাড় কাটা রোধসহ বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম বা আভাসস্থল রক্ষায় পরিবেশ অধিদফতার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে পরিবেশ অধিদফতর।

পাঠকের মতামত: