অথচ সার্ক প্রতিষ্ঠার সময় কথা ছিল, দুই সদস্য দেশের দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে সেখানে কোনও আলোচনা হবে না – এই প্ল্যাটফর্মে গুরুত্ব পাবে শুধুই আঞ্চলিক বিষয়।
কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে তার উল্টোটাই ঘটেছে – ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের ছায়া সার্ককে বারবারই অকার্যকর করে তুলেছে। কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হল, দুদেশের বিশ্লেষকরাই বা এ নিয়ে কী ভাবছেন?
তিন দশক আগে ঢাকায় ‘সার্ক’ নামে যে আঞ্চলিক জোটের জন্ম হয়েছিল, তার নামের মধ্যেই ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার অঙ্গীকার।
কিন্তু যেখানে জোটের সবচেয়ে বড় দুটো দেশের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবেই নিরন্তর সংঘাত লেগে আছে, সেখানে তারা কেউই কিন্তু কিন্তু দ্বিপাক্ষিকতার ঊর্ধ্বে উঠে জোটের স্বার্থ দেখতে পারেনি। আর ভারত এর জন্য সরাসরি দায়ী করে থাকে পাকিস্তানকেই।
“পাকিস্তান আসলে ভারতের সঙ্গে তাদের দ্বিপাক্ষিক ইস্যুগুলোকে, কাশ্মীর সমস্যাকে যে কোনও মাধ্যমে সব সময় তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানের জন্মের ইতিহাস, ভারত-বিরোধিতায় কীভাবে তাদের অস্তিত্ত্ব নিহিত এগুলো সবারই জানা – আর সে কারণেই সার্কে আঞ্চলিক ইস্যুকে তারা কখনও গুরুত্ব দেয়নি, তাদের কাছে প্রাধান্য পেয়েছে শুধুই দ্বিপাক্ষিক বিষয়।”
সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তীর এই কথার পিঠে ঠিক উল্টো যুক্তি দিচ্ছেন দিল্লিতে পাকিস্তানের সাবেক হাইকমিশনার আজিজ আহমেদ খান। তিনি বলছিলেন, সার্ক সনদকে বারবার অমর্যাদা করেছে ভারতই।
তাঁর বক্তব্য, “দেখুন, সার্ক ফোরাম মূলত আাঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনার জায়গা – কিন্তু ভারত সেই চার্টার কখনও মানতে চায়নি। সার্কের শীর্ষ সম্মেলন প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মাঝের অনেক বছরেই সামিট বাতিল করতে হয়েছে – ভারত কোনও না কোনও অজুহাত তুলে বাগড়া দিয়েছে বলে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবারেও তারা একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি করল।”
কিন্তু সার্কের মঞ্চে দ্বিপাক্ষিক বিষয়গুলো দূরে সরিয়ে রেখে অন্য বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে অসুবিধা কোথায়?
পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী মনে করেন, পাকিস্তান আসলে সার্ককেও ভারতকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে – আর গন্ডগোলটা সেখানেই।
“ওদের ধারণা, সার্কে যে কোনও আঞ্চলিক উদ্যোগে যদি বাধা দেওয়া হয় – তাহলে অন্য সদস্য দেশগুলো ভারতের ওপর চাপ দেবে, ভারতকে সবাই মিলে বলবে তোমরা বিষয়টা একটু দেখ। অতীত দেখলে দেখা যাবে বারে বারে তারা এই কারণেই নানা পদক্ষেপে বাধা দিয়েছে।”
“যেমন ধরুন, কানেক্টিভিটি নিয়ে যখন সার্ক জুড়ে মোটর ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্ট করার প্রস্তাব এল – পাকিস্তান বলল তোমরা করলে কর, আমরা ওতে নেই। ফলে বাধ্য হয়ে বিবিআইএন এগ্রিমেন্ট করা হল, সমঝোতাটা রিজিওনাল থেকে সাব-রিজিওনাল হয়ে গেল। এভাবেই একটু-আধটু কাজ হচ্ছে, তবে সার্কের মূল ভিশন আর এগোচ্ছে না।”, বলছেন মিঃ চক্রবর্তী।
তবে এর জের ধরে সার্ক পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যেতে পারে, সেটা মানেন না আজিজ আহমেদ খান। বরং তার বিশ্বাস, ভারতও একদিন ঠিকই নিজের ভুলটা বুঝতে পারবে।
মিঃ খান বলছেন, “সার্ক এতে শেষ হয়ে যাবে আমি মনে করি না। ভারত এখন কড়া অবস্থান নিতে চাইছে, কিন্তু তারা ঠিকই বুঝবে – সম্মেলন এ বছর না-হলেও পরের বছর নিশ্চয় হবে। আগেও এই জিনিস হয়েছে, ভারত নিজের ভুল বুঝে সার্কে ফিরে এসেছে। সার্ক পরিবারের সবচেয়ে বড় সদস্য এই জোটের বিরুদ্ধেই অন্তর্ঘাত করতে চাইবে এটা তো কখনওই ভাল দেখায় না – তাই আমার বিশ্বাস ভারতও এক সময় বুঝবে যেটা তারা করেছে ঠিক করেনি।”
ফলে সার্কের শেষ শীর্ষ সম্মেলন অনেক আগেই হয়ে গেছে, এটা বলার সময় হয়তো এখনও আসেনি।
কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাত যতদিন বজায় থাকবে, এই আঞ্চলিক জোট যে কিছুতেই মসৃণভাবে এগোতে পারবে না সেই দেওয়াল-লিখনও কিন্তু পরিষ্কার।বিবিসি
পাঠকের মতামত: