ঢাকা,বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

বিয়ের আগে মেডিকেল টেস্ট কতটা জরুরি?

biyeডেস্ক নিউজ:

বিয়ের আগে মেডিকেল টেস্ট কতটা জরুরি তা আগের প্রজন্ম না বুঝলেও, আজকালকার আধুনিক ছেলেমেয়েরা কিন্তু এর গুরুত্ব ঠিক বুঝতে পারছে। ছেলে বা মেয়েকে হেয় করার জন্য নয়, বিয়ের আগে তাদের কয়েকটি মেডিকেল টেস্ট করানো অতি আবশ্যক বলে মনে করছেন সচেতন মানুষ।

এদিকে বিয়ের আগে পাঁচটি মেডিকেলে টেস্ট অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়ে মানুষের ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক প্রখ্যাত মনোচিকিৎসক ডা. এম মোহিত কামাল পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘এটা তো সায়েন্টিফিক্যালি দেখতে হবে। অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের কোনো জায়গা নেই। এখন আমরা দেখছি রক্তের গ্রুপের মিলের কারণে বাচ্চাদের অনেক ধরনের রোগ দেখা দেয়। তাহলে আগে থেকেই এটা রক্ত পরীক্ষা করে জেনে নিলে সমস্য কী? বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করা মানেই আমরা এটাকে নেগেটিভলি দেখি। এটাকে পজেটিভলি দেখতে হবে। এ কারণে ১ হাজারের মধ্যে ৫টা বা ১০টা ডিফেক্ট বাচ্চা হয়। তো আগে থেকেই আমরা যদি এই সমস্যাগুলো জানতে পারি তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম রক্ষা পাবে। তাহলে আগে থেকে সমস্য জানতে পারলে ক্ষতি কি?’

তিনি আরো বলেন, ‘অনেকে মনে করে বিয়ের আগে রক্তের পরীক্ষা মানেই ছেলে বা মেয়ে ডিফেক্ট। এটা অন্ধত্ব। এ ধারণার ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। পরবর্তীতে সমস্যা হওয়ার আগেই সচেতন হতে হবে। আমাদের একটা প্রবাদ আছে- ‘ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।’ এই প্রবাদটা তো পুরোপুরি একটা বিজ্ঞান। যদি কোনো ছেলে বা মেয়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ হয় তাহলে বিয়ের আগে অপরপক্ষের অবশ্যই রক্তের গ্রুপটা পরীক্ষা করা উচিৎ। যদি সেখানে দুজনেরই নেগেটিভ হয় তাহলে তো অনেক সমস্য হবে। সেক্ষেত্রে বিয়েটা করা ঠিক হবে না।’

সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিৎ এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. এম মোহিত কামাল বলেন, ‘এগুলো সরকারি নীতিমালা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। এটাকে ব্যক্তি সচেতনতা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। আমি বলব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। যেখানে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করা দরকার সেখানে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করেই বিয়ে করাতে হবে।’

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ইনফার্টিলিটি ধাত্রী বিশেষজ্ঞ ড. জাকিউর রহমান পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘মেডিকেলে গ্রাউন্ডে যদি একটা বিয়ে ভেঙে যায় আমাদের সমাজ সেটাকে ভালোভাবে নেয় না। ধরেন একটা মেয়ের রক্তের গ্রুপ যদি নেগেটিভ হয় তাহলে অনেক সময় গর্ভধারণে সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় বাবা বা মায়ের ডায়াবেটিস থাকলে তাদের সন্তানের এ সমস্যা হতে পারে। এগুলো আজ-কাল কোনো মারাত্মক রোগ না। কিছু জিনিস নিয়ন্ত্রণ করলেই তো এগুলো ঠিক হয়ে যায়। যদি একটা সমস্যা গোপনে আগে থেকেই জেনে নেওয়া যায় তাহলে সেই সমস্যাটা খুব সহজেই সমাধান করা যায়। এটা সচেতনতার একটা অংশ। আজও মানুষ রোগ না হলে পরীক্ষা করাতে চাই না। এখনও দেখেন বেশির ভাগ লোক নিজের রক্তের গ্রুপ জানে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘বিয়ের আগে মেডিকেলে টেস্ট কতটা জরুরি তা তো এক কথায় বলা যাবে না। এটা অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। সামাজিক, পারিবারিক, শিক্ষাগত যোগ্যতা সব কিছু বিবেচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মানুষকে নিজে প্রথমে সচেতন হতে হবে। ধরেন বিয়ের আগে একটি ছেলের শরীরের অবস্থা কি? সে বাবা হতে পারবে কি না এটা নিজে থেকেই জেনে রাখা দরকার। এখানে লজ্জার কোনো বিষয় নেই। যে কোনো লোকেরই এ সমস্যা থাকতে পারে। এ বিষয়টা শুনতে হয়ত ভালো শোনাচ্ছে না। কিন্তু যদি আগে থেকে না জানা হয় তাহলে এটা কিন্তু আরো বেশি মারাত্মক।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গাইনি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. খায়রুন নাহার পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বিয়ের আগে মেডিকেল টেস্ট করা মানুষের সচেতনতার অংশ বলা যেতে পারে। যেমন কিছু কিছু রোগ আছে সেগুলো আগে থেকে জানতে পারলে ভালো হয়। এটা যে শুধু রক্ত পরীক্ষা করে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তা নয়। কিছু কিছু রোগ আছে আমরা দেখি আত্মীয়তার মধ্যে বিয়ের ফলে বেশি হয়ে থাকে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বেশি ভালো।’

বিয়ের আগে মেডিকেল টেস্টের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কি কি পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে এ পসঙ্গে জানতে চাইলে খায়রুন নাহার আরো বলেন, ‘বিয়ের আগে মেডিকেলে টেস্ট এটা যে খারাপ কিছু না বরং অনেক ভালো এটা মানুষকে বোঝাতে পারলেই হবে। এটা তো সত্য কথা নানা কারণে মানুষের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে।’

‘আমাদের দেশে কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষিত পরিবারে আরো অনেক বেশি। আগে থেকেই যদি আমরা সচেতন না হয় তাহলে তো আমাদের পরবর্তী জেনারেশর এর ফল ভোগ করবে’- যোগ করেন খায়রুন নাহার।

বিয়ের আগে যে পাঁচটি মেডিকেল টেস্ট করা জরুরি:

বিশেষ চেকআপ :

১। থ্যালাসেমিয়া জাতীয় হিমোগ্লোবিনোপ্যাথি টেস্ট করে অবশ্যই দেখে নেওয়া উচিত, কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কিনা। বাহক হলে অনাগত শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এটি এমন ধরনের এক রক্তের অসুখ যাতে রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কমে যায়। ফলে রোগীকে প্রতি ৩ থেকে ৮ সপ্তাহ পর পর ব্লাড ট্র্যান্সফিউশন করতে হতে পারে। এই ব্লাড ট্র্যান্সফিউশনের ফলে অনেক সময় রক্তে আয়রন জমে যেতে পারে ও যার থেকে হার্ট, লিভার, প্যানক্রিয়াসের ক্ষতি হতে পারে। ফলে বিশেষ থেরাপির সাহায্যে নিয়মিত শরীর থেকে আয়রন পরিষ্কার করতে হয়। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন তা হলে বংশানুক্রমে তা বাচ্চার মধ্যেও চলে আসতে পারে। তাই এই টেস্ট আবশ্যক।

২। অত্যন্ত সংক্রামক টক্সোপ্লাজমা, রুবেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাস, হারপিস সিমপ্লেক্স এইসব অসুখ একজনের হলে তা অন্য আরেকজনের শরীরে সংক্রামিত হতে পারে। তাই বিয়ের আগে টক্সোপ্লাজমা, রুবেলা, সাইটোমেগালো ভাইরাস, হারপিস সিমপ্লেক্স এর পরীক্ষা করে তা দেখে নেওয়া উচিত।

সাধারণ হেলথ চেকআপ :

১। ব্লাড কাউন্ট, হিমোগ্লোবিন টেস্ট করে দেখে নেওয়া উচিত অ্যানিমিয়া রয়েছে কি না। অ্যানিমিয়া থাকলে শরীরে দুর্বলতা দেখা দেয়, সংক্রামিত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। বাচ্চা হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফলে টেস্টে অ্যানিমিয়া ধরা পড়লে, তা চিকিৎসা করে নেওয়া প্রয়োজন।

২। ব্লাড সুগার টেস্ট করে দেখে নেওয়া উচিত ডায়াবেটিস রয়েছে কিনা। ডায়াবেটিসে অনেক ক্ষেত্রে ইনসুলিন নিতে হয়। সেই ক্ষেত্রে বাচ্চা হওয়ার সময় মায়ের বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন, তার নিয়ন্ত্রিত লাইফস্টাইলের প্রয়োজন। ফলে বিয়ের আগে সুগার টেস্ট করে দেখে নেওয়া উচিত ডায়াবেটিস রয়েছে কিনা। থাকলে তার চিকিৎসা করাতে হবে।

৩। লিভার টেস্ট করে দেখে নেওয়া উচিত লিভার ফাংশন ঠিক রয়েছে কি না। হেপাটাইটিস এ, বি, সি ঠিক রয়েছে কিনা। হেপাটাইটিস এ সেরে গেলেও, পাত্রী যদি হেপাটাইটিস বি, কিংবা সি-এর অধিকারী হন তাহলে তার থেকে তা সংক্রামিত হয়ে স্বামী ও বাচ্চার শরীরে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিয়ের আগেই দুজনেরই হেপাটাইটিস-এ ও বি ভ্যাকসিন নিয়ে রাখা উচিৎ।

৪। বুক এক্স-রে করে দেখে নেওয়া উচিত কারও কোন রকম টিউবার কুলেসিস রয়েছে কিনা। থাকলে তার চিকিৎসা করানো উচিৎ।

৫। কোলেস্টেরল, লিপিড প্রোফাইল, কিছু আনুষঙ্গিক পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া উচিত হার্টের অবস্থা কেমন রয়েছে। কোলেস্টেরল বেশি থাকলে ওষুধের সাথে জীবনযাত্রা সংযত রাখাও প্রয়োজন। ফলে আগাম পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় কোলেস্টেরল বেশি তার চিকিৎসা করা উচিৎ।

৬। ইউরিয়া টেস্ট করে দেখা উচিত কিডনির ফাংশন কেমন রয়েছে। ইউরিয়া বেশি থাকলে তার থেকে বাচ্চার সমস্যা দেখা দিতে পারে। ফলে আগে থেকেই চেকআপ করিয়ে নেওয়া ভালো। সমস্যা থাকলে চিকিৎসা করে নেওয়া প্রয়োজন।

৭। থাইরয়েড পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। থাইরয়েড কম কিংবা বেশি রয়েছে কিনা। কারণ থাইরয়েড সমস্যা থেকে পরবর্তীতে বাচ্চা হওয়ার সময় সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই আগেই চেকআপ করিয়ে নিন সমস্যা থাকলে চিকিৎসা করিয়ে ফেলুন।

৮। রুটিন চেকাআপ হিসেবে দাঁত এবং চোখের পাওয়ার, রেটিনা একবার পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো।

গাইনোকলজিকাল চেকআপ :

১। গাইনোকলজিস্টের কাছে গিয়ে পাত্রীর একবার পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া উচিত ইউটেরাস, ওভারিতে কোনোরকম সমস্যা আছে কিনা, জেনিটাল ট্র্যাকে কোন সমস্যা আছে কি না। থাকলে তার চিকিৎসা করিয়ে নেওয়া উচিৎ।

২। ব্রেস্ট পরীক্ষা করে দেখে নেওয়া উচিত ব্রেস্টে কোন লাম্প আছে কিনা। লাম্প ধরা পড়লে তার পরীক্ষা করে নেওয়া ভালো।

সেক্সুয়াল হেলথ চেকআপ :

১। পাত্র যদি মনে করে থাকেন তার পুরুষত্বহীনতা, বীর্যপাতজনিত সমস্যা বা পুরুষাঙ্গে কোনো সমস্যা রয়েছে, তা হলে আগে থেকেই সেক্সোলজিস্টের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিন।

মানসিক স্বাস্থ্য চেকআপ :

বিয়ের আগে নিজেকে ঠিকমত চেনা, জানার জন্য, বিয়ের জন্য তারা কতখানি প্রস্তুত জেনে নেওয়ার জন্য পাত্র-পাত্রীর উচিত আগে থেকেই কোনও কাউন্সেলরের সাথে কাউন্সেলিং করে জেনে নেওয়া, বিয়ের পর তিনি নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে শারীরিক, মানসিকভাবে মানিয়ে চলার ক্ষেত্রে কতখানি প্রস্তুত রয়েছেন।

পাঠকের মতামত: