ঢাকা,বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

বিদেশি কুকুর দিয়ে বাড়ি পাহারা!

আবদুল মান্নান
 

আবদুল মান্নান ::: আবদুল মান্নান :::

আবদুল মান্নান
 

প্রথমে একটি সত্য গল্প দিয়ে লেখাটি শুরু করি। আমার পরিচিত বাংলাদেশের একজন বড় মাপের সফল শিল্পোদ্যোক্তা, যিনি ইউরোপের বাজারের জন্য তাঁর ঢাকার কারখানায় বেশ নামকরা কয়েকটি ব্র্যান্ডের চামড়াজাত পণ্য তৈরি করেন। একদিন দুঃখ করে বলছিলেন, বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষের বিদেশপ্রীতির কারণে তিনি বেশ মর্মপীড়ায় ভোগেন। তাঁর পেশার অনেক শিল্পপতি আর ব্যবসায়ী আছেন যাঁদের জন্য বাংলাদেশকে ততক্ষণ পর্যন্ত ভালো, যতক্ষণ এ দেশে ব্যবসা করে মোটামুটি গুলশান-বনানীতে দু-একটি বিলাসবহুল বাড়ি আর কোটি টাকা দামের গাড়ির মালিক হতে পারেন। ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ যখন কয়েক শ কোটিতে গিয়ে ঠেকে তখন বাংলাদেশ আর নিরাপদ নয় বলে দুবাই, কুয়ালালামপুর অথবা লন্ডন, কানাডায় সেকেন্ড হোমের মালিক হয়ে সেখানে পরিবারের সদস্যদের পাঠিয়ে দেন। বলেন, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া আর পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তাঁদের এ কাজটি করতে হয়েছে। আমার সেই পরিচিতজন আরো জানালেন, তিনি যখন প্রতিদিন সাভারে তাঁর কারখানায় আসা-যাওয়া করেন তখন একটি বাড়ির সামনে একটি সাইনবোর্ড দেখে বেশ মজা পান। সেই বোর্ডে লেখা আছে ‘বিদেশি কুকুর দ্বারা এই বাড়ি পাহারা দেওয়া হয়।’ তিনি বললেন, আমাদের একশ্রেণির মানুষের দেশপ্রেম এমন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে যে বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য এখন আর দেশি কুকুরের ওপর নির্ভর করা যাচ্ছে না। দেশি হলে সেটি হয় কুত্তা আর বিদেশি হলে তা হয় কুকুর। তার আবার একটি বাহারি নামও থাকে। এই ধরুন ‘টমি, সিলভি অথবা প্রিন্স’। আর কুত্তাদের তো কোনো নাম থাকতে নেই।

লেখার শুরুতে এই ভূমিকার অবতারণা করার কারণ হচ্ছে, কয় দিন আগে এক ভদ্রলোক আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। তিনি কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স ও একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। বিদেশের একটি উঁচু মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন। একাধিক নামকরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃত জার্নালে তাঁর বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রবন্ধও রয়েছে। কিছুদিন থাকবেন বলে দেশে এসেছেন। বসে না থেকে কোনো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন বলে বিজ্ঞাপন দেখে একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। তাঁকে সাক্ষাত্কারেও ডাকা হয়েছিল। সাক্ষাত্কারে উপস্থিত হলে ভদ্রলোককে বলা হয়, তাঁকে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তাঁর কোনো বিদেশি ডিগ্রি নেই। তিনি পাল্টা জানতে চান বিদেশি ডিগ্রি থাকতে হবে তা তো বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল না। উত্তরে সেই সাক্ষাত্কার বোর্ডের একজন কর্তাব্যক্তি বলেন, তা লিখলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চরম আপত্তি করে। এত সব ঝুটঝামেলার মধ্যে না গিয়ে তাঁরা সাক্ষাত্কারে ডেকে প্রার্থীকে দু-একটি প্রশ্ন করে বিদায় করেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশপ্রীতি এমনই চরমে পৌঁছেছে যে ইতিহাস পড়ানোর জন্যও তারা কিছুদিন হলো পশ্চিমবঙ্গের একজন বাঙালি ভারতীয়কে নিয়োগ দিয়েছে। অন্য কোনো বিভাগের হলে তেমন হয়তো আপত্তি উঠত না। কিন্তু ইতিহাস পড়ানোর জন্যও বিদেশ থেকে শিক্ষক আনতে হবে, তা অবিশ্বাস্য ও অগ্রহণযোগ্য। আমার সহকর্মী সদ্য অবসরে যাওয়া ড. মুনতাসীর মামুন এই সম্পর্কে কী মন্তব্য করবেন, তা জানি না। যে বিভাগে এই শিক্ষক কর্মরত সেই বিভাগের প্রধান একজন সজ্জন ব্যক্তি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের দাপটের কাছে তিনি অনেকটা অসহায়। অন্য বিভাগগুলোর ক্ষেত্রেও তাই। ইতিহাসের সেই শিক্ষক তাঁর বিদেশি স্ত্রীকেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়ে নিয়ে আসার পাঁয়তারা করছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। মহিলা বর্তমানে কলকাতায় অবস্থান করছেন। বাদ সেধেছে আমাদের বোর্ড অব ইনভেস্টমেন্ট। তারা নাকি মহিলাকে ওয়ার্ক পারমিট দিতে গড়িমসি করছে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত-আটজন সাদা চামড়ার শিক্ষক অধ্যাপনা করছেন। তাঁদের কতজনের বৈধ ওয়ার্ক পারমিট আছে আর কতজন এই দেশে আয়কর দেন তা জানা নেই। এই সাদা চামড়ার শিক্ষকরা যে তেমন কোনো খ্যাতিমান পণ্ডিত ব্যক্তি তা-ও নয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদা চামড়ার শিক্ষক থাকলে নাকি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শান-শওকত আর জেল্লা বাড়ে। তাঁদের বেতন ‘নেটিভ’ শিক্ষকদের তুলনায় সাত-দশ গুণ বেশি। আসবাবসহ অ্যাপার্টমেন্ট তাঁদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচে বরাদ্দ। কর্তাব্যক্তিদের বিদেশপ্রীতি এমন অবস্থায় গেছে যে বছরে দু-একটি বোর্ড সভা অনুষ্ঠান অথবা একাডেমিক সফরের নামে সস্ত্রীক বিদেশভ্রমণ তাঁদের জন্য এখন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। দেশে সভা করলে সিটিং অ্যালাউন্স জনপ্রতি লাখ টাকা। প্রশ্ন উঠতে পারে, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি কি বাংলাদেশের বাইরে? না বাংলাদেশের ভেতরে, কিন্তু তাদের হাত এতই লম্বা যে তারা অনেকটা দেশের মধ্যে অন্য আর একটি দেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। তাদের সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি তদন্ত করেছিল। তারপর কেমন করে যেন সব চাপা পড়ে গেল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একাধিক ছাত্র জঙ্গি সম্পৃক্ততার কারণে দেশে ও দেশের বাইরে আটক হয়েছে। কিন্তু তার পরও কাঁচা পয়সাওয়ালাদের কাছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কদর আকাশচুম্বী।

ওপরের বর্ণনা পড়ে মনে হতে পারে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা বুঝি এ রকম। মোটেও তা নয়। দেশে বর্তমানে কমপক্ষে ডজনখানেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেগুলোতে এ ধরনের ‘বিদেশি কুকুরের পাহারা’ সংস্কৃতি নেই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তারা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মনে করেন না। সেখান থেকে পাস করে অনেকেই দেশে ও বিদেশে ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। কয়েক ব্যাচ আগে বিসিএস পরীক্ষায় যে ছাত্রটি প্রথম হয়েছে সে একটি দ্বিতীয় প্রজন্মের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্র। বৃত্তি নিয়ে জাপান গিয়েছিল। বিসিএসের ফল প্রকাশিত হলে চাকরিতে যোগ দিতে দেশে ফিরে এসেছে। গত ১৯ তারিখ ১৮ জনের একটি সরকারি প্রতিনিধিদল নিয়ে জাপান গিয়েছিলাম সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক বিনিময় ও গবেষণা ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে সরকার গঠন করে শিক্ষাকে একটি অগ্রাধিকার সেক্টর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে যে সরকারি বাজেট ও প্রকল্প সহায়তা মিলছে তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তা আরো বেশি প্রযোজ্য। অনেকে বলে থাকেন, গবেষণা ক্ষেত্রে সরকার যে সহায়তা দেয় তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হয়তো সত্য। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গবেষণা খাতের বরাদ্দ সময়মতো খরচ করতে পারে না। তার পরও আগামী বছর গবেষণা খাতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মঞ্জুরি কমিশনের তরফ থেকে চলতি বছরের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেশি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০০৯ সালে সরকার পাঁচটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে শনাক্ত করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পাঁচটি নতুন প্রকৌশল ও কারিগরি বিভাগ খুলে সেসব বিভাগের উন্নয়নের জন্য ২০ মিলিয়ন ডলারের একটি বড় তহবিল বরাদ্দ দিয়েছে। জাপান সফরের উদ্দেশ্য ছিল এসব বিভাগের জন্য জাপানি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে সহায়তার ব্যবস্থা করা। জাপানের যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই গেছি, দেখেছি তারা বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-গবেষকদের সম্পর্কে বেশ উঁচু ধারণা পোষণ করে। তারা চায় আরো বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-গবেষক জাপান যাক। পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থী আছে ঠিক একইভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেখানে বেশ ভালো করছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের সফলতা দেখলে কার না ভালো লাগে? জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তাদের নিজ দেশের গ্র্যাজুয়েটদের কদর সবচেয়ে বেশি। সেখানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি অসংখ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সবার মান যে সমান তা কিন্তু নয়। কিন্তু কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা নিয়োগকর্তা কখনো বলে না নিয়োগের ক্ষেত্রে উত্তর আমেরিকার গ্র্যাজুয়েটদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যেমন করে বাংলাদেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করে। অথবা চাকরির ক্ষেত্রে বলা থাকে শুধু অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা আবেদন করতে পারবে। চাকরি নির্ভর করা উচিত মেধার ওপর। অধ্যাপক আহমদ শরীফ বা অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেননি। মেধার স্বীকৃতি না দিয়ে পশ্চিমা ডিগ্রি (তাও উত্তর আমেরিকার হতে হবে) অগ্রাধিকার দেওয়া চরম হীনম্মন্যতা। জাপানের মানুষ অসম্ভবভাবে নিজ দেশের জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে। তাদের প্রত্যেকটি মানুষের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা বাধ্য হয়ে সমর্থন করে। কারণ চীন বা উত্তর কোরিয়ার সামরিক হুমকি মোকাবিলার জন্য দেশটি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তিকে দেওয়া মুচলেখার কারণে জাপান কোনো বড় ধরনের সামরিক বাহিনী গঠন করতে পারে না। কিন্তু এর বাইরে তারা সব কিছুতেই নিজ দেশকে খুঁজে বেড়ায়। বিদেশি কুকুর দিয়ে বাড়ি পাহারা দেওয়ার অভ্যাস তারা কখনো করেনি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের প্রত্যেকটি মানুষের যদি জাপানের মানুষের মতো দেশপ্রেম থাকত, তাহলে বাংলাদেশ বর্তমানের চেয়ে আরো কম সময়ে অনেক বেশি উন্নত হতে পারত। না হওয়ার প্রথম কারণ বিদেশি কুকুর দিয়ে বাড়ি পাহারা দেওয়ার কাজটি করানোর মানুষের সংখ্যা সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আছে। শুধু ওপরে বর্ণিত বিশ্ববিদ্যালয়ই ব্যতিক্রম নয়। এমন অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে গজিয়ে উঠেছে, যেখানে শিক্ষার কারিকুলাম এমনভাবে করা হয় যে সেসব স্কুলে যারা পড়ালেখা করে তারা দেশ, তার ইতিহাস, সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকে। স্কুলে বাংলায় কথা বলা নিষিদ্ধ। সিডনি অপেরা হাউস কোথায় তারা সহজে বলতে পারে। সাভার স্মৃতিসৌধ কোথায় বা সেটি কী এবং কেন সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। বার্গার আর পিত্জা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। কিন্তু ভাপা পিঠা বা পাটিসাপটা কী সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। জাপানে প্রাথমিক শিক্ষায় পঠিত প্রধান বিষয় হচ্ছে নিজ দেশকে জানা। আর বাংলাদেশে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশ সম্পর্কে না জানাটা বর্তমানে ফ্যাশন হয়ে গেছে। এই না জানার জন্য শিক্ষার্থীদের কোনো দোষ নেই। দোষ পরিবার আর শিক্ষাব্যবস্থার। যত দিন আমরা বিদেশি কুকুরের পেছনে ছুটতে থাকব তত দিন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হবে না। বিদেশি কুকুর দ্বারা বাড়ি পাহারার সংস্কৃতি বর্জন করার এখনই সময়।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

পাঠকের মতামত: