নুরুল কবির ,বান্দরবান থেকে :: বান্দরবানে পাহাড়ি বন উজাড় করে কাঠ এবং ঝিরি-খাল থেকে ‘অবৈধভাবে পাথর সরাচ্ছেন’ বান্দরবান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম কোম্পানী, আর এ জন্য তিনি ক্ষমতার দাপটে বানিয়েছেন রাস্তা। আব্দুর রহিম কোম্পানী সদর উপজেলা টংকাবতি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক।
তিনি ব্যক্তি মালিকানাধীন বাগান থেকে কাঠ কিনছেন বলে দাবি করলেও কোনো অনুমতিপত্র দেখাতে পারেননি। তিনি পাথর তোলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এ নেতা। তার নিজ বাড়ি লোহাগাড়ার পদুয়া ইউনিয়নে ।
খালের ওপর বাঁধ দিয়ে রাস্তা নির্মাণের ফলে ওই এলাকার প্রাণ- প্রবাহ বেকায়দায় পড়েছে। তিনি দাবি করলেন রাস্তা তৈরি করায় লোকজনের চলাচলে সুবিধা হচ্ছে।
অবিলম্বে তার এই ‘বিধ্বংসী কর্মকান্ড থামানোর দাবি জানিয়েছেন এলাকার বসবাসরত মুরু সম্প্রদায়েরা। টংকাবতি ইউনিয়ন পরিষদ নব-নিবাচিত চেয়ারম্যান মাংয়ং ম্রো বলেছেন, “গত বছর টংকাবতির রঞ্জুপাড়া থেকে বলিপাড়া পর্যন্ত বুলডোজার চালিয়ে পাহাড় কেটে এই রাস্তা তৈরি করেছেন আব্দুর রহিম কোম্পানী। এত বড় রাস্তা দেখলে মনে হবে সরকারি কোনো প্রকল্প। শুধু গাছ ও প্রাকৃতিক পাথর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য একজন ব্যবসায়ী অবৈধভাবে এই রাস্তা তৈরি করেছেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
প্রায় সময়“এই রাস্তা দিয়ে দিনের বেলায় গাছ টানা হয়। এলাকবাসী বাধা দেওয়ায় রাতের অন্ধকারে ঝিরি ও খালের প্রাকৃতিক পাথর গুলো তুলে নিয়ে যায়।” ওই এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, রঞ্জুপাড়া থেকে বলিপাড়া পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় খালের উপর ছোট-বড় ১৪টি বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। কয়েকটি খাল জুড়ে কোথাও পাথরের স্তূপ, কোথাও আবার গাছের স্তূপ দেখা গেছে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, খালের ওপর বাঁধ দেওয়ায় পানি প্রবাহ কমে গেছে এবং ঝিরির ওপর দিয়ে গাড়ি চলাচলের কারণে পানি ঘোলা হয়ে থাকে সারাদিন। এতে এই পানির ওপর নির্ভরশীল এলাকাবাসী বেকায়দায় পড়েছেন। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়েছে বনের প্রাণীরা। সব মিলিয়ে ওই এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে। এলাকাবাসী এ অবস্থার দ্রুত অবসান চেয়েছেন।
এদিকে গাছ টানতে সিলেট থেকে দুইটা হাতি আনা হয়েছে বলে শ্রমিকরা জানান। জঙ্গলের ভেতর যেসব জায়গায় হাঁটাচলা করা যায় না সেসব জায়গা থেকে হাতি দিয়ে গাছ টানা হয় বলেও তারা জানান। নিজেকে নেতখাইং ম্রো নামে পরিচয় দিয়ে এক ব্যক্তি বলেন, তিনি ওই শ্রমিকদের জন্য রান্নাবান্না করেন।
“হাতির মাহুত, গাছ ও পাথর টানার কাজে নিয়োজিত কয়েকজন শ্রমিক থাকেন এখানে। সাংবাদিক আসার খবর পেয়ে তারা সবাই কোথাও চলে গেছে। হাতি নিয়ে দূরে জঙ্গলের ভেতর কোথাও গিয়ে লুকিয়ে আছেন তারা।”বলিপাড়ার বাসিন্দা রেংরাও ম্রো সাংবাদিকদের বলেন, “কয়েক দিন ধরে একদল শ্রমিক গাছ কাটে। আরেক দল শ্রমিক খালে পাথর সংগ্রহ করে স্তূপ করে রাখে। গাছগুলো দিনের বেলায় নিয়ে গেলেও পাথর নেয় রাতের অন্ধকারে। ট্রাক এসে তুলে নিয়ে যায়।
“বাধা দিলে আব্দুর রহিম বলেন, তিনি মৌজাপ্রধান ও পাড়াপ্রধানের কাছ থেকে বাগান কিনেছেন।”
পাড়াপ্রধান দনরুই ম্রো বলেন, “এ পাড়ায় ২৭টি ম্রো পরিবার রয়েছে। পাড়ার আটটি পরিবার প্রধানমন্ত্রীর উপহার ঘর পেয়েছে। এসব ঘর নির্মাণ করতে গাড়ি দিয়ে গত বছর ইট নিয়ে আসার কথা বলে আব্দুর রহিম এই রাস্তাটা তৈরি করেন। এখন দেখি এই রাস্তা দিয়ে গাছ ও পাথর নিয়ে যাচ্ছেন আব্দুর রহিম।” দক্ষিণ হাঙ্গর মৌজাপ্রধান পারিং ম্রো বলেন, “আব্দুর রহিমের কাছে আমার ব্যক্তিগত সেগুন ও গামারি বাগান বিক্রি করা হয়েছে। কিন্তু পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করার কথা তো বলা হয়নি। বাগান বিক্রি করার পর জেলা প্রশাসন ও বনবিভাগ থেকে অনুমিত নিয়ে কাঠ সরানোর দায়িত্ব আব্দুর রহিমের। কিন্তু এখন দেখছি পুরো পরিবেশ নষ্ট করে ফেলছেন আব্দুর রহিম।”
আব্দুর রহিম দাবি করেন, স্থানীয়দের চলাচলের সুবিধার জন্য রাস্তাটা তৈরি করা হয়েছে। জঙ্গলের ভেতর থেকে গাছ টানার জন্য সিলেট থেকে দুইটা হাতি আনার কথাও তিনি স্বীকার করেন। আব্দুর রহিম বলেন, “একটা হাতি বাবদ দৈনিক তিন হাজার টাকা করে দেওয়া হয়।”
তিনি আরও বলেন গাছ কাটার বিষয়ে বলেন, “সংরক্ষিত কোনো বন থেকে গাছ কাটা হয় না। এলাকার কারও ব্যক্তিগত বাগান কিনে গাছ কাটা হয়।”পাথর সরানোর কথা তিনি অস্বীকার করেছেন। আব্দুর রহিম বলেন, “ওই এলাকা থেকে কোনো পাথর উত্তোলন করা হয়নি।” ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগান কিনেছেন বলে দাবি করলেও তিনি জেলা প্রশাসন ও বনবিভাগের অনুমতিপত্র দেখাতে পারেননি।
বনবিভাগের টংকাবতি রেঞ্জ কর্মকর্তা মঈনুদ্দিন বলেন, “খবর পেয়ে মঙ্গলবার ওই এলাকায় অভিযান চালানো হয়। গামারি, গুটগুটি, কড়ই ও কনক গাছের ৭০টি টুকরো জব্দ করা হয়েছে। সেগুলো এখনও ফুট হিসেবে মাপা হয়নি।”আর ইতোমধ্যেই যেসব কাঠ সরিয়ে ফেলা হয়েছে সে বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সে বিষয়ে এই বনকর্মকর্তা কিছু বলতে পারেননি। বনবিভাগের চোখের সামনে এত দিন ধরে গাছ কেটে সরানো হল সে বিষয়েও তিনি কিছু বলতে পারেননি।
পাঠকের মতামত: