মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া :: কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৫০ শয্যা বিশিষ্ট নয়া চারতলা ভবন নির্মাণ কাজে ব্যাপক ক্রটি ও সীমাহীন অনিয়ম-দূর্নীতির কারণে ভবন নির্মাণের ১বছর ৩মাসের মধ্যে বিভিন্ন অংশে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে! স্থানীয়রা এ জন্য কাজ তদারকীর দায়িত্বে থাকা কক্সবাজার স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ও কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারকে দায়ী করছেন।
গতকাল ২৭ জুন দুপুরে পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরেজমিন পরিদর্মন করে ভবনের নয়া চারতলা ভবনের বিভিন্ন অংশে ফাটলের চিহ্ন দেখা গেছে। নিচ তলায় কিচেন কক্ষের সামনে পিলারে ও ভবনের প্রবেশ পথে একটি পিলারে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও ভবনের ৩য় তলায় নার্সেস অফিসার্স কক্ষের বাইরের বারান্দার উপরে রিন্টারে ও নিচের দেওয়ালে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে ভবনের আরো বিভিন্ন অংশে ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। প্রসঙ্গত: পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ২০ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে বিগত ২০১৮ইংরেজীর ২৭ সেপ্টেম্বর চার তলা ভবন নির্মাণ কাজ উদ্বোধন হয়। এবং ঠিকাদার কর্তৃক অনিয়ম দূর্নীতির মাধ্যমে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নির্মাণ কাজ শেষ হয় গেল ২০২০ ইংরেজীর ২৫ মার্চ।
স্থানীয়রা জানান, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবন নির্মাণ কাজের শুরু থেকেই শিডিউল অনুযায়ী কাজ করেনি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের মেসার্স কাসেম এন্ড ব্রাদার্স। তবে উক্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্টানের কাছ থেকে সাব-কন্টাকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের কাজটি বাস্তবায়ন করেছেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার শ্রী নিবাস দাশ সাগর নামের এক প্রভাবশালী। কাজের শুরুতে মাটির নিচে ৮৫ ফুট পাইল বসাতে গিয়ে ৭ থেকে ১০ ফুট ভেঙ্গে যায়। কাজের শুরু থেকেই শেষ পর্যন্ত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ভবন নির্মাণের কাজ শিডিউল বহির্ভূতভাবে কাজ বাস্তবায়ন করায় বর্তমানে ভবনের বিভিন্ন অংশে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। অতি নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ উক্ত ভবনের নির্মাণ কাজ করলেও সেসময় অভিযুক্ত ঠিকাদারের বিরুদ্ধে রহস্যজনক কারণে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কক্সবাজারের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।
অভিযোগ ঊঠেছে, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভবন নির্মাণে তদারকীর দায়িত্বে থাকা কক্সবাজার স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকৌশলী মোরশদ আলমকে ম্যানেজ করেই ঠিকাদারের লোকজন ‘যেনতেনভাবে’ কাজ শেষ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট ভবন হস্তান্তরও করেছেন। তবে ওই প্রকৌশলী ‘ম্যনেজ’ হওয়ার বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করেছেন। প্রসঙ্গত: দীর্ঘদিন ধরে প্রকৌশলী মোরশেদ আলম কক্সবাজারে কর্মরত থাকার সুবাধে জেলার কেনা উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ কাজ হলে কার্যাদেশপ্রাপ্ত ঠিকাদারের লোকজনের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে সরকারী কাজ তদারকীতে চরম অবহেলার প্রদর্শনেরও অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের অধীনে প্রায় ১৪ কোটি টাকারও বেশি বাজেটের পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ৪তলা ভবন নির্মাণের জন্য কার্যাদেশ পেয়েছিলেন চট্টগ্রামের কাসেম এন্ড ব্রাদার্স নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্টান। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, ঠিকাদারী প্রতিষ্টান নিজেরা কাজটি বাস্তবায়ন না করে অন্য লোককে কাজটি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আর সাব কন্টাকে ভবনের কাজ করতে গিয়ে সীমাহীন অনিয়ম ও দূর্নীতি হয়েছে। স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী গণপূর্ত বিভাগের নিয়ম মোতাবেক ৪ তলা ভবন নির্মাণের কর্ম তালিকায় মাটি পরীক্ষা করে ৪তলা ভবনের জন্য ৮৫ ফিট করে প্রায় দুইশটি পাইল বসানোর জন্য ঠিকাদারের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছিল ভবন ডিজাইনার। তবে কাজের শুরুতেই নিম্নমানের পাইল তৈরি করায় তা মাটির নিচে বসানোর ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। পাইল বসাতে গিয়ে পাইলের উপরিভাগে যখন হ্যামারিং করা হয়, তখন ৮৫ ফিট পাইলের ৭ থেকে ১০ ফিট ভেঙ্গে যায়। যে টুকু বসানো হয়েছিল, পাইলে তাতেও সেসময় ফাটল ধরেছিল। ভবন নির্মাণ কাজের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি পাইলের মাথায় ফলস ক্যাপের মাধ্যমে মাটির গ্রাউন্ড লেবেল থেকে ৩ ফুট নিচে বসানোর কথা, কিন্তু তা না বসিয়ে পাইলের মাথাগুলো মাটির গ্রাউন্ড লেবেলের উপরে রেখেই চার থেকে পাঁচ ফিট ভেঙ্গে রডগুলো হ্যাক্সো বেন্ড দিয়ে কেটে দুমড়ে-মুচড়ে করা হয়েছিল।
পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নয়া ৪ তলা ভবনের বিভিন্ন অংশে ফাটল প্রসঙ্গে জানতে ২৮ জুন (সোমবার) সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ে কর্মরত উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. মোরশেদ আলমের সাথে মুঠোফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, বর্ষাকাল চলছে তাই ভবন বসে যাচ্ছে। হয়তো এ কারণে ফাটল সৃষ্টি হলেও তা ভবনের জন্য কোন সমস্যা হবেনা। এরপরেও ফাটল সৃষ্টি হলে ঠিকাদারের মাধ্যমে ফাটলগুলো পুনারায় মেরামত করা হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
কক্সবাজারের বেসরকারী ফার্মে নিয়োজিত একজন নির্মাণ প্রকৌশলী সূত্রে জানা যায়, প্রত্যেক ভবনেরই মূল চাপ বহন করে পাইল, আর এক্ষেত্রে নিয়মানুযায়ী সঠিকভাবে পাইল তৈরি না হলে এবং সঠিক নিয়মে পাইল ড্রাইভ না করলে অবশ্যই যে কোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার আশংকা থেকে যায়।
পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও প:প: কর্মকর্তা ডাক্তার মোহাম্মদ ছাবের এ প্রসঙ্গে জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনে ফাটলের বিষয়টি তাঁর জানা নেই। এরপরেও ভবনে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে কিনা তিনি ২৯ জুন মঙ্গলবার খোঁজ নিয়ে দেখবেন। ভবনে ফাটল সৃষ্টির প্রমাণ পাওয়া গেলে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেও জানান।
পাঠকের মতামত: