ছোটন কান্তি নাথ, চকরিয়া :: স্বামী সুরেশ চন্দ্র শীল মারা যাওয়ার দশদিনের মাথায় একসঙ্গে পাঁচপুত্র হারানো বৃদ্ধা মৃণালিনী শীল, স্বামীহারা পাঁচ পুত্রবধূসহ পরিবার সদস্য, আত্মীয়-স্বজনেরা এখনো শোকে মুহ্যমান। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী সুরেশ এবং তাঁর পাঁচ পুত্রের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে অশৌচকালীন সময় (১৪ দিন) পর্যন্ত পরিবারের সব সদস্যসহ পুরো গোষ্ঠী ছিলেন নিরামিষভোজী। সুরেশের মৃত্যুর ১১ দিনে এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে চারদিনের মাথায় পাঁচ পুত্রের পারলৌকিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
গতকাল দুপুরে শোকার্ত বাড়িতে গেলে কথা হয় প্রয়াত সুরেশের স্ত্রী মৃণালিনী শীলের সঙ্গে।
মানু বালা হিসেবেও তাকে চেনেন স্বজনেরা। এ সময় তিনি দুই হাত তুলে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা গুরুতর আহত রক্তিম শীল, মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিষ্টান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হীরা শীল এবং ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত পুত্র প্লাবন শীল যাতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।
এ সময় তিনি বলতে থাকেন, ‘আমার পরীক্ষা তো অনেক হয়ে গেছে। আর কত পরীক্ষার সম্মুখিন করবেন ভগবান। স্বামীর পর একসঙ্গে পাঁচ সন্তানকে তো কেড়ে নিলেন। এবার একটু দয়া করুন। যাতে আমার দুই সন্তান দুনিয়াতে বেচে থাকেন। ’
পরদিন গতকাল শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ছিল পরিবারের সব সদস্যদের মুখে আমিষ জাতীয় (মাছ, মাংসসহ) খাবার মুখে নেওয়ার রীতি। দুই দফায় শ্রাদ্ধানুষ্ঠান উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে শোকার্ত পরিবারে আসা স্বজনেরা এদিন সম্মতি দিলে সবাই আমিষ জাতীয় খাবার মুখে নেন। এরপর থেকে তারা নিয়মিত স্বাভাবিকভাবে আমিষ খাবার আস্বাদন করতে পারেন। অবশেষে সেই নিয়মই পালন করা হলো পারলৌকিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের সর্বশেষ ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী।
শনিবার সকালে কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাটের হাসিনাপাড়ায় সুরেশ চন্দ্র শীলের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, উঠানের মধ্যেই চলছে রান্না-বান্না। এরপর দুপুরের দিকে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে সেখানে থরে থরে কলাপাতা বিছিয়ে তার ওপর থালাভর্তি করে ভাত এবং আমিষ জাতীয় খাবার রাখছেন। তার পর আত্মীয়-স্বজনেরা প্রয়াত সুরেশের স্ত্রী বৃদ্ধা মৃণালিনী শীল, স্বামীহারা পাঁচ পুত্রবধূ যথাক্রমে নিহত অনুপমের স্ত্রী পপী শীল, নিরূপম শীলের স্ত্রী গীতা শীল, দীপক শীলের স্ত্রী পূঁজা শীল, চম্পক শীলের স্ত্রী দেবীকা শীল ও শরণ শীলের স্ত্রী কৃষ্ণা শীল এবং তাদের পুত্র-কন্যাদের বসিয়ে আমিষ জাতীয় খাবার মুখে নেওয়ার অনুমতি দিচ্ছেন। এরপর তারা মুখে নিচ্ছেন সেই খাবার। একইসাথে আত্মীয়-স্বজন এবং পাড়া-প্রতিবেশীরাও তাদের সাথে বসে সেই খাবার খাচ্ছেন।
সরজমিন দেখা গেছে, স্বজনেরা আমিষ জাতীয় খাবার মুখে নেওয়ার অনুমতি দিলেও বৃদ্ধা মৃণালিনী এবং একসঙ্গে স্বামীহারা হওয়া পাঁচ পুত্রবধূ খাবারের টেবিলে বসেও কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তারা খাবার মুখেও নিতে পারছিলেন না। এ সময় স্বজনেরা তাদের সান্তনা দিয়ে মুখে খাবারও তুলে দেন। ধর্মীয় বিধান যেহেতু রয়েছে, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা একটু করে হলেও সেই খাবার মুখে নেন। একইসাথে তাদের সন্তানেরাও সেই খাবার মুখে দেন।
একই গোষ্ঠির মধ্যে কোন সদস্য মারা গেলে ধর্মীয় বিধানমতে পারলৌকিক ক্রিয়ানুষ্ঠানের সর্বশেষ এই আচার পালন করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। এমনটিই জানালেন প্রয়াত সুরেশ চন্দ্র শীলের ছোট ভাই চিত্তরঞ্জন শীলসহ উপস্থিত স্বজনেরা।
এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি কেউ : স্বামী সুরেশ চন্দ্র শীল মারা যাওয়ার দশদিনের মাথায় পারলৌকিক ক্রিয়ানুষ্ঠানের আচার হিসেবে নির্জন স্থানে ‘দণ্ডি’ দিতে যায় ৯ ভাই-বোন। এ সময় পিকআপ চাপায় একসঙ্গে পাঁচ পুত্র নিহত এবং আরো দুই পুত্র-কন্যা রক্তিম শীল ও হীরা শীল গুরুতর আহত হওয়া ছাড়া আরেক পুত্র প্লাবন শীল ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়। এরইমধ্যে ধর্মীয় নানা আচার পালনের রীতি। এসব কিছু সামাল দেওয়ার পরও তারা স্বাভাবিক হতে পারেননি। অকালে একসঙ্গে এতজন সদস্যকে হারানোর শোকে ক্ষণে ক্ষণে কেঁদে উঠছেন তারা।
পাঠকের মতামত: