শামীমুল হক :: তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে এমনটাই বলা হয়েছে। নিষিদ্ধ হলেও কৌশলে প্রচারণা চলছে দেশজুড়ে। আইনেরই সুযোগে এমনটা করছে ব্যবসায়ীরা। আইনে বিক্রয়স্থলে পণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়নি। এটাই সুযোগ এনে দেয় ব্যবসায়ীদের। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শনকে বিজ্ঞাপন প্রচারের কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছে তামাক কোম্পানিগুলো। যেখানে মূল টার্গেট তরুণরা।
তামাকের কারণে বাংলাদেশে ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ বছরে মারা যায়। ভোক্তা হারানোর এই শূন্যতা পূরণে কোম্পানিগুলো টার্গেট করে শিশু-কিশোর ও তরুণদের। বর্তমানে দেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৪৯ শতাংশই তরুণ যারা কোনো না কোনো ভাবে তামাক কোম্পানির এই আগ্রাসী প্রচার কৌশলের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
তামাকপণ্য প্রদর্শনকে বিজ্ঞাপন প্রচারের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেটে ডিজাইনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেয় তামাক কোম্পানিগুলো। এমনকি বিক্রয়কেন্দ্রে দৃশ্যমান স্থানে তামাকপণ্যের প্যাকেট সাজিয়ে রাখতে তারা বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং আর্থিক প্রণোদনা দেয়।
টোব্যাকো অ্যাটলাস এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ লাখ ৭২ হাজারের বেশি। একটি সমীক্ষায় ঢাকার স্কুলগুলোর আশপাশে প্রায় ৭৫ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে কোনো না কোনো উপায়ে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন এবং ৩০ শতাংশ খুচরা বিক্রেতাকে শিশুদের চোখ বরাবর স্থানে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে। ঢাকার ৭৬ শতাংশ পয়েন্ট অব সেল বা বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন হয়।
শিশুদের প্রলুব্ধ করতে তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট বা মোড়ক শিশুদের প্রিয় খাবার যেমন, ক্যান্ডি, চকলেট প্রভৃতির পাশে বা দৃষ্টি-সীমার মধ্যে রাখা হয়। নরওয়ের একটি গবেষণায় বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন দেখে প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় কিশোরদের মধ্যে সিগারেট ক্রয়ে উৎসাহিত হওয়ার উচ্চ প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। নিউজিল্যান্ডেও বিক্রয়স্থলে বেশি মাত্রায় তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন দেখে ধূমপান শুরু করতে উৎসাহিত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। অস্ট্রেলিয়ায় এক-তৃতীয়াংশ উত্তরদাতা বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন দেখে সিগারেট ক্রয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছে বলে জানিয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকপণ্য প্রদর্শনের কারণে বর্তমান তামাক ব্যবহারকারীদের অনেকেই তামাক ছাড়ার বিষয়ে আগ্রহী হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী তরুণদের নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডে আকৃষ্ট করতে পৃথিবীব্যাপী বছরে ৯০০ কোটি ডলার ব্যয় করে তামাক কোম্পানিগুলো।
তামাকজাত দ্রব্য বিপণনে কোম্পানিগুলোর এ কৌশল মোকাবিলার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) এর ধারা ১৩ ও এ সংক্রান্ত গাইডলাইন অনুযায়ী বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন, বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা এবং পৃষ্ঠপোষকতা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন’ শীর্ষক সাউথ এশিয়ান স্পিকার’স সামিট এর সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন এবং এই লক্ষ্য অর্জনে বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে এফসিটিসি’র সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে সংশোধন করার ঘোষণা দেন।
বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করে বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করলেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
এক গবেষণায় ৭৭টি দেশের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হলে দৈনিক ধূমপানের প্রবণতা প্রায় ৭% হ্রাস পায়। তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ ইউরোপের এমন ছয়টি দেশে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিশোর বয়সীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা হ্রাসে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করার কার্যকর প্রভাব রয়েছে। বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধের পর আইসল্যান্ড ও কানাডায় প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ধূমপানের হার ১০ শতাংশ কমেছে। নেপাল, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এবং নরওয়েসহ বিশ্বের ৫০টি দেশ ইতিমধ্যে পয়েন্ট অব সেল বা বিক্রয়স্থলে তামাকজাত দ্রব্যের প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছে। মানবজমিন
পাঠকের মতামত: