অনলাইন স্বাস্থ্য ডেস্ক ::
ক্যালবো-ডি উচ্চমাত্রার একটি ক্যালসিয়াম ওষুধ। দেশের শীর্ষপর্যায়ের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানটির এ ওষুধটি আছে সারা দেশেই। দৃষ্টিনন্দন মোড়কে দামও বেশি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে—বহুল প্রচলিত এ ওষুধের নকল সংস্করণও পাওয়া গেছে বাজারে। দেখতে একই রকম হওয়ায় সাধারণ রোগীদের পক্ষে আসল-নকল চিনতে পারা কঠিন।
আবার নামকরা কোনো কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারেও মিলছে রোগ নির্ণয়ের অকার্যকর উপাদান, যেখান থেকে রোগীরা পায় ভুয়া রিপোর্ট। এমন সব নকল-ভেজাল ওষুধ আর ভুয়া রিপোর্ট নিয়ে বাড়ছে শঙ্কা ও উদ্বেগ। বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থায় আধুনিকায়ন ও উন্নতি গত কয়েক বছরে ক্ষেত্রবিশেষে বিশ্বমানে পৌঁছে গেলেও এখনো বড় বাধা হয়ে আছে নকল-ভেজাল ওষুধ এবং রোগ নির্ণয়ে ভুল ও অসাধু তৎপরতা। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এসবের শিকার হচ্ছে। সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে উল্টো তাদের জীবন আরো বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে; যা নিয়ে এখন অতিষ্ঠ ও শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন চিকিৎসকরা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দাবি, চিকিৎসার মূল ভিত্তি হচ্ছে রোগ নির্ণয় এবং ওষুধ। চিকিৎসকরা শুধু এই দুয়ের মাঝখানে যোগসূত্র ঘটিয়ে দেন। তাই রোগ নির্ণয়ে গলদ বা ওষুধ নকল-ভেজাল কিংবা অকার্যকর থাকলে পুরো চিকিৎসাই অকার্যকর হয়ে যায়, চিকিৎসকের পরামর্শ কোনো কাজে আসে না। সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হলে দেশে দক্ষ ও নিষ্ঠাবান চিকিৎসকদের পাশাপাশি অবশ্যই নিরাপদ ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ভেজাল ও নকল ওষুধ এবং ভুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে রোগীদের রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগী আলতাফ হোসেন বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই নিয়মিত কয়েকটি আইটেমের ওষুধ খেতে হচ্ছে। সব সময় হয়তো একই ফার্মেসি থেকে ওষুধ কেনা যায় না। এতে করে মাঝেমধ্যেই টের পাই, কোনো কোনো ওষুধ কাজ করে না বা অস্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। পরে ডাক্তারকে জানালে তাঁরা বিষয়টি বুঝতে পেরে ওষুধের ব্র্যান্ড পাল্টে দেন। এখন বড় ভয়ে আছি কখন না বিপদ হয়ে যায় নকল ওষুধের কবলে পড়ে।’
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. সারফুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘রোগ ভালো না হলেই মানুষ কথায় কথায় চিকিৎসককে গাল দেয়, চিকিৎসকের ওপর আস্থার প্রশ্ন তোলে। কিন্তু চিকিৎসকরা যেই রোগ নির্ণয়ের ফলাফল দেখে পরামর্শ দেন সেই ফলাফলে যদি গলদ থাকে তবে তাঁদের কী করার আছে। আবার রিপোর্ট ঠিক থাকলেও যদি ওষুধ নকল বা ভেজাল হয় সেটার দায় তো আর চিকিৎসকের না। এই বিষয়গুলোও মানুষের বুঝতে হবে এবং নকল ভেজাল ওষুধ ও গলদপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।’ তিনি বলেন, মাঝে মাঝে যে অভিযান করা হয় তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই, কিন্তু এর মাত্রা বাড়াতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে যার যার জায়গা থেকে আরো জোরালো মনিটরিং চালাতে হবে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ওষুধ বিপ্লবের সুবাদে দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধ। দেশে এখন কেবল অ্যালোপ্যাথিক আইটেমেরই ২০৮টি ওষুধ কম্পানি তিন হাজার ৫৮৮ জেনেরিকের প্রায় ৩০ হাজার ব্র্যান্ডের বিভিন্ন প্রকারের ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে। সরকার অনুমোদিত এসব ওষুধের অনেকগুলোর মান নিয়ে যেমন অভিযোগ ও প্রশ্ন রয়েছে, আবার এর বাইরে খোলাবাজারে রয়েছে কোটি কোটি টাকার নকল ও ভেজাল ওষুধ। মাঝেমধ্যেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে জব্দ করার পর প্রমাণ মেলে। সব শেষ গত ১ আগস্ট দেশের সবচেয়ে বড় ওষুধের বাজার মিটফোর্ড এলাকায় এমনই এক অভিযানে ধরা পড়ে প্রায় ২০ কোটি টাকার নকল-ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ।
কেবল ওষুধই নয়, ভুয়া পরীক্ষা, ভেজাল ও অকার্যকর উপাদানে রোগ নির্ণয়ের কারণেও রোগীরা ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে থাকে বা সুফল পায় না। আবার একেক প্রতিষ্ঠানে একেক রকম ফল আসে। মোরশেদা বেগম নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘গত মাসেই তিনি তাঁর বোনের সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শে ধানমণ্ডির একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যান। সেখান থেকে পরীক্ষায় তাঁর বোনের এক ধরনের ক্যান্সার হয়েছে বলে রিপোর্ট দেয়। কিন্তু পরে অন্য জায়গায় পরীক্ষা করিয়ে দেখা যায় ক্যান্সার নয়, সংক্রমণ হয়েছে। কিন্তু যখন ক্যান্সারের কথা বলেছে তখন আমরা পুরো পরিবার খুবই ভেঙে পড়েছিলাম।’
এমন নানা অভিযাগের মুখে গত মাসে নগরীর ধানমণ্ডিসহ কয়েকটি এলাকার কিছু নামিদামি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ভেজাল, নিম্নমানের, মেয়াদোত্তীর্ণ ও অকার্যকর রোগ নির্ণয় উপাদান উদ্ধার ও জব্দ করে র্যাবের টিম। সেই সঙ্গে প্রমাণ পায় ভুয়া রিপোর্ট তৈরির। এসব ক্ষেত্রে সাজা ও জরিমানাও করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুসারে দেশে প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। এর অনেকগুলোয় অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ বা যোগ্য জনবল থাকে না। ভুয়া জনবল দিয়ে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করা হয়।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার আলম বলেন, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা হচ্ছে পুরোটাই একটি সমন্বিত পন্থা। যার মূলেই রয়েছে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ। এ দুটি জায়গায় গলদ থাকলে পুরো চিকিৎসাই গলদপূর্ণ হয়ে যাবে। ভুল রোগ নির্ণয় আর ভেজাল-নকল ওষুধের ব্যবহার কিছুতেই চলতে দেওয়া যাবে না। কারণ এতে মানুষ সুস্থ হওয়ার পরিবর্তে উল্টো মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তিনি বলেন, ‘আমাদের অভিযানের ফলে ভেজাল-নকল ওষুধের উপদ্রব আগের তুলনায় কিছুটা কমলেও এখনো প্রত্যাশিত হারে কমছে না। কারণ সারা দেশে একযোগে এ অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরকে আরো কঠোরভাবে মনিটরিং বাড়াতে হবে। কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না। কারণ যেসব ওষুধ নকল হয় তা সাধারণ মানুষের পক্ষে দেখে বুঝতে পারা সম্ভব নয়। আবার রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে একই পরিস্থিতি। অসাধু চক্র মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে নিজেরা টাকা কামানোর লোভে নানা সুযোগে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা থামব না।’
ওষুধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘কেবল অভিযান চালিয়ে এ অবস্থা থেকে মানুষকে রক্ষা করা মুশকিল। বরং এ ধরনের ওষুধ তৈরির সুযোগ যাতে না থাকে সেদিকে নজরদারি বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, কেবল ভেজাল ও নকল ওষুধই নয়—লাইসন্সেধারী অনেক কম্পানিই নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করছে। সেসবের বিরুদ্ধেও অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি তৎপর। নিয়মিত বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালানো হয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা। জোরালো মনিটরিং চলছে। ফলে বিপুল পরিমাণ ভেজাল, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধরা পড়ছে।’
পাঠকের মতামত: