ঢাকা,বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

দেশে ফেরার আকুতি সালাহ উদ্দিনের: নির্বিকার বিএনপি!

বাংলাট্রিবিউন ::  ‘চেষ্টা করছি দেশে ফেরত যাওয়ার কিন্তু কোনোভাবেই হয়ে উঠছে না। কবে আদালত খুলবে, তাও অনিশ্চিত’–বলছিলেন ৫ বছরের বেশি সময় ধরে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অপেক্ষায় থাকা বিএনপির পোড় খাওয়া রাজনীতিক সালাহ উদ্দিন আহমেদ। শনিবার (৩০ মে) রাতে মুঠোফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি এ কথা বলেন।

সালাহ উদ্দিন আহমেদ জানান–তার শরীর ভালো নেই, আছে শারীরিক আরও জটিলতা। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে ভাড়া করা একটি কটেজেই একাকী জীবন কাটছে তার।

২০১৫ সালের ১১ মে থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে আছেন বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ। আর তার আগের দুই মাস দেশের ভেতরেই ছিলেন নিখোঁজ। সব মিলিয়ে ৫ বছর ২ মাস ২১ দিন ধরে একা স্বাভাবিক জীবনের বাইরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য। দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ, ২০১৫ সালের ১০ মার্চ গভীর রাতে রাজধানীর উত্তরার ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি নম্বর সড়কে ৪৯/বি নম্বর বাড়ির ২/বি নম্বর ফ্ল্যাট থেকে র‌্যাব ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে সালাহ উদ্দিনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে দুই মাস পর পাশের দেশ ভারতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় তাকে। উদ্ধারের পর তার বিরুদ্ধে দেশটিতে অনুপ্রবেশের দায়ে মামলা হয়। প্রায় সাড়ে তিন বছর মামলার কার্যক্রম চলার পর ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ হয়। ওই বছরের ২৬ অক্টোবর আদালতের রায়ে অনুপ্রবেশের দায়ে করা মামলায় নির্দোষ হিসেবে রায় পান সালাহ উদ্দিন আহমেদ। পরে আবার ভারত সরকারপক্ষ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে।

সালাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, খুব স্বল্প কিছু কাজের মধ্য দিয়েই সময় কাটছে তার। কাজের মধ্যে ইবাদত, বইপড়া, একটু হাঁটাহাঁটি, মাঝে-মাঝে পরিবারের সঙ্গে ভার্চুয়ালি কথাবার্তা–এইসব সুনির্দিষ্ট।

শনিবার রাতে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা হয় সালাহ উদ্দিন আহমেদের। শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল অবস্থায় আছি। শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। অনেক কমপ্লিকেশন তো আছেই। এখানে আসার পর দুটো মেজর অপারেশনও হয়েছে। সব মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছি।’

চিকিৎসা কীভাবে হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখন তো সবকিছুই বন্ধ। আগে তো আদালতের অনুমতি নিয়ে বাইরে যেতাম, শিলংয়েও চিকিৎসা নিতাম। কিন্তু এখন তো সব লকডাউনে বন্ধ অনেকদিন।’

শিলংয়ে চিকিৎসা ও জীবনযাপনের আর্থিক পুরো বিষয়টি পারিবারিকভাবে করা হচ্ছে বলে জানান সালাহ উদ্দিন, বলেন; ‘এগুলো তো সবই নিজস্ব।’

বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘আমি তো প্রায় চার বছর ধরে আইনিভাবে লড়ছি। কোর্টের নির্দেশে তো জামিন পেয়েছি। আদেশ অনুযায়ী আমাকে ফেরত পাঠানোর কথা কিন্তু সেটা না করে আপিল করেছে ভারতের সরকার পক্ষ। আপিল করার পরও প্রায় দেড় বছর চলে গেছে। এখনও আপিল শুনানি ঠিকমতো শুরু হয় নাই। এরমধ্যে গত ফেব্রুয়ারি থেকে আদালতের কার্যক্রম লকডাউনে বন্ধ। কবে হবে, আর কিছু বলা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন……।’

এক প্রশ্নের জবাবে সালাহ উদ্দিন বলেন, ‘এটা তো জানা কথা, বাংলাদেশ সরকারের কোনও আগ্রহ না থাকলে কোনও আপিল হয় না।’

সারাদিন কীভাবে সময় কাটে? এমন প্রসঙ্গে সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সময় কেটে যায়, একটু পড়াশোনা করি, ইবাদত-বন্দেগী আর হাঁটাচলা করি। অনলাইন নিউজ-পেপার পড়ি।’

সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিনি তো ভালো নেই, শারীরিক-মানসিক সব দিক থেকেই অসুস্থ। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি দেশে আনতে। পাঁচ-ছয় বছর বিদেশে পড়ে আছেন, বুঝতেই পারছেন তার কী অবস্থা। এরমধ্যে এখন কোভিড-১৯ ভাইরাস। সব মিলিয়ে অসহনীয় পরিস্থিতি, মনে হয় কখনও বাঁচার আশাই ছেড়ে দিয়েছি।’

করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে শিলংয়ে স্বামী সালাহ উদ্দিন আহমেদকে দেখে এসেছেন হাসিনা আহমেদ। বলেন; ‘আগের মতো অবস্থায়ই আছে। আমাদের তো কিছু করার নেই’, বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

বিএনপি নির্বিকার?

২০১৫ সালের মার্চে যখন সালাহ উদ্দিন নিখোঁজ হন, ওই সময়ে বিএনপি পুরোদমে আন্দোলনে; অনেকটাই গেরিলা-উপায়ে দলের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করছিলেন তখন সালাহউদ্দিন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়িয়ে অজানা জায়গা থেকে প্রতিদিন দলের কর্মসূচি ও নেতাকর্মীদের কাছে শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশনা গণমাধ্যমে মাধ্যমে পাঠানোর কাজটি করতেন নিয়মিত। ২০১৩ সালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য, তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ ঢাকার গ্রহণযোগ্য নেতারা যখন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে, তখন সালাহ উদ্দিন আহমেদ দলের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেছেন। দলের চরম সংকটকালে নির্দেশনা মেনে চললেও ধরা পড়ে দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর এখন ভারতে মুক্ত অবস্থাতেও এক রকম অন্তরীণ আছেন তিনি। অথচ তাকে দেশে ফেরাতে বিএনপির দলীয়ভাবে দৃশ্যমান বা গোপন কোনও উদ্যোগই নেই, বলে দাবি করেন দলটির বিভিন্ন স্তরের কয়েকজন নেতা।

বিএনপির ফরেইন রিলেশন্স (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক) কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘২০১৫ সালে ঢাকা সফরররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকেও সালাহ উদ্দিনের প্রসঙ্গটি তুলেছেন বিএনপির প্রধান। বিষয়টিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করার অনুরোধও ছিল ম্যাডামের পক্ষ থেকে। কিন্তু কোনও অগ্রগতি হয়নি।’

বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, দলীয় নীতিনির্ধারক ও শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে সালাহ উদ্দিন আহমেদের প্রসঙ্গটি গুরুত্বের সঙ্গে জায়গা পাচ্ছে না। বিশেষ করে স্থায়ী কমিটির কয়েকজন সদস্য দলীয় ফরেইন রিলেশন্স কমিটিকে এ ব্যাপারে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকলেও তা দেখা যায়নি। খালেদা জিয়ার কাছে তার অনেক গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি দলীয় ঘরানায় বিপুলভাবে আলোচিত। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকজন নেতা যোগাযোগ করলেও দলীয়ভাবে কোনও উদ্যোগ নেই।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ১১ মে দুপুরে খালেদা জিয়া সরকারের প্রতি কড়া বিবৃতি দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন বিএনপির মতো একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী। তাঁর মতো একজন গুরুত্বপূর্ণ নাগরিককে দীর্ঘদিন গায়েব করে রেখে যদি সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসন নির্বিকার থাকতে পারে, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা কোথায়? দেশে আইন ও প্রাতিষ্ঠানিকতা কি বিলুপ্ত হয়ে গেছে? কাউকে কি কখনও কোনোকিছুর দায় নিতে বা জবাবদিহি করতে হবে না?’

দলীয় চেয়ারপারসনের কাছে সব সময়ই গুরুত্ব পেয়েছেন সালাহ উদ্দিন আহমেদ। ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এপিএস ছিলেন সালাহ উদ্দিন। ২০০১ সালে তিনি কক্সবাজার থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনি যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হন। ভারতে আটক হওয়ার সময় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। পরে ওই দেশে থাকা অবস্থাতেই ২০১৬ সালে বিএনপির ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর তাকে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মনোনীত করেন খালেদা জিয়া।

বিএনপির একটি দায়িত্বশীলসূত্র জানায়, করোনাভাইরাস মহামারিকালে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন তার পরিবার। এক্ষেত্রে সালাহ উদ্দিন আহমেদের বিষয়টি আইনি জায়গায় আটকে থাকলেও তা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে, বলেই জানায় সূত্রটি। তবে এ বিষয়েও সরকারের উচ্চপর্যায়ে তদ্বিরের প্রয়োজন বলে মনে করে সূত্রটি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রবিবার (৩১ মে) বিকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ফরেইন রিলেশন্স কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সালাহ উদ্দিন আহমেদকে তো সেখানকার আদালত বেকসুর খালাস দিয়েছিল, এরপর রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। কিন্তু শুনানি শুরু হয়নি। তিনি তো মামলায় জিতেছেন। এই ধরনের রাজনৈতিক অবস্থায়, দীর্ঘ একটি মামলায় তাকে এভাবে ফেলে রাখার কোনও কারণ আমরা দেখছি না।’

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘তার ভারতে প্রবেশের বিষয়টি ওপেন-সিক্রেট। এটা তো বাংলাদেশ-ভারতের সবাই জানেন। তাকে তুলে নিয়ে সেখানে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এটা তো এমন কিছু না, তিনি নিম্ন আদালতে জিতেছেন। এরপরও এটা নিয়ে এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা…আমার মনে হয় আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের জন্য এটা বোধহয় ইয়ে হচ্ছে না।’

‘‘দীর্ঘদিন ধরে এটার জন্য ইয়ে করতে হয়, এটা তো খুব দুর্ভাগ্যজনক দুই দেশের জন্য’’-যোগ করেন সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী।

আমীর খসরু বলেন, ‘বর্তমান সরকারের এ বিষয়টি আর দীর্ঘায়িত করা উচিত বলে মনে করি না। বিশেষ করে এই করোনাভাইরাসের এই সময়ে ভারত সরকার আরও উদার হয়ে তাকে ছেড়ে দিতে পারেন। ভারত সরকারও জানে, বিষয়টি আসলে কী। এটা কারও অজানা না। এটার জন্য গবেষণার দরকার নাই। ফলে, করোনা মহামারিতে মানুষ স্বাস্থ্য,মনের দিক থেকে, চারদিক থেকে সমস্যায় আছে। মানবতার দিক থেকেও এটা সঠিক নয়।’

শনিবার রাতে দলের নীতি নির্ধারণী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘এগুলো তো লিগ্যাল ম্যাটার। দল কী করবে। আদালতের ব্যাপার তো আমাকেই দেখতে হবে।’ আর তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ বলেন, ‘সরকার যদি কিছু করে সেটা সরকারের ব্যাপার, একটা মানুষ আর বিদেশে কত একা-একা পড়ে থাকবে। আমাদের চিন্তা করারও শক্তি নাই আর।’

বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে সালাহ উদ্দিন আহমেদ দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে বলেন, ‘সব সময়ই আমি বলি, দেশবাসী যেন আমার জন্য দোয়া করেন। চেষ্টা করছি দেশে ফেরত যাওয়ার কিন্তু কোনোভাবেই হয়ে উঠছে না।’

পাঠকের মতামত: