শাহেদ মিজান :: কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে পৃথিবীজুড়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। পৃথিবীর বহুদেশ এই বিদ্যুৎপ্রকল্প বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এই প্রেক্ষাপটেও মাত্র ৪০ কিলোমিটারের ছোট্ট দ্বীপ মহেশখালীতে ১৫টি কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে মহেশখালী বিরানসহ কক্সবাজারেও ক্ষতিকর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা শুর” থেকেই বলে আসছেন পরিবেশবিদরা। এবার সেই কথা আরো কঠোরভাবে বললেন দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বুদ্ধিজীবি ড.সলিমুল্লাহ খান। গত ৪ ডিসেম্বর এক টেলিভিশন টকশোতে তিনি তাঁর আশঙ্কার কথা জানান।
টকশোর ওই ভিডিও মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকসহ সর্বমাধ্যমে। এই আশঙ্কার কথা শুনে মহেশখালীর মানুষ চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। একই সাথে তারা চরম আতঙ্কিতও বোধ করছে। ফেসবুকসহ ও মাঠে-ঘাটে এই নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে।
টকশোতে মহেশখালীর কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে ড. সলিমুল্লাহ খানের বলা কথাগুলো হুবুহু তুলে ধরা হলো- আমার যে দ্বীপে জন্ম সেটার নাম মহেশখালী। এই বর্তমান সরকার পরিকল্পনা করছে জাপানের সাথে সেখানে একটা নয়, দু’টা নয়, তিনটা নয়, পাঁচটা নয়, পনেরোটা কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করবে।এবং কক্সবাজার জেলার ৫০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে এইরকম ১৭টা হবে! তো সেখানে কি জীবন থাকবে? আমার মা-বাবার কবর আছে ওখানে। আমার কবর জেয়ারত করতে যেতে হবে। কিন্তু আমি লিখে দিতে পারি ৩০ বছরে সেখানে একটা মানুষ থাকতে পারবেনা! এটা আমি জানি! তো জেনে আমি কী করে বিষণ্ণ না হয়ে থাকবো? আমার ভাই বোনেরা বলে যে, “তুমি তো মহেশখালীতে আসো না।” আমি তো দেখতেই পারছি মহেশখালী থাকবেনা ৩০ বছরের মধ্যে। মহেশখালী হচ্ছে বাংলাদেশের একমাত্র দ্বীপ যেখানে ৪০-৫০ মাইলের মতো সরকারি সংরক্ষিত পাহাড়ি বন আছে।সেখানে প্রাণী বৈচিত্র্য ছিলো, সেখানে হরিণ ছিলো, একসময় হাতি এবং বাঘও ছিলো। তা এখন দেখা যায় না। সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে! এখন যেটা হচ্ছে সেখানে তো একটা জনপ্রাণী থাকবেনা। এখন যে ভাসানচরে রোহিঙ্গা লোক নিয়ে যেতে চাচ্ছে ধরেন, মহেশখালী তো একটা মরুভূমি তে পরিণত হবে! আচ্ছা জেনেশুনে যে বিষ আমি পান করছি, বিষণ্ণ কথাটার মধ্যে ‘বিষ’ শব্দটা আছে খেয়াল করছেন? এই যে আমি তো দেখতে পারছি আমার জন্মভূমি হঠাৎ করে একটা মরুভূমিতে পরিণত হচ্ছে। নাইলে আমি বলি মহেশখালী কী দোষ করলো? যদি কোন রাজনৈতিক ন্যায়বিচার থাকতো, একটি দ্বীপে আপনি কেন ১৫ টা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র করবেন? পৃথিবীর অন্যান্য দেশে জার্মানিতে বলেন, অস্ট্রেলীয়াই বলেন আমরা সকলে দেখে আসছি যেখানে একটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়, কয়লা ভিত্তিক তার ৫০ মাইলে ব্যাসার্ধের মধ্যে কোন মানুষ থাকতে পারেনা। তাদের ক্যান্সার হয়! মহেশখালীতে কোন রাজনৈতিক শৃঙ্খলা নই বলেই এইটা সম্ভব হচ্ছে। হয়তো কেউ প্রতিবাদ করেনা। আমি প্রতিবাদ করে পত্রিকায় লিখেছি, আমি তো গরীব মানুষ বেশি পত্রিকায় লিখতে পারবোনা, দেশরূপান্তরে লিখেছিলাম, বলেছিলাম যে অভিযোগ করছিলাম অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ এর বিরুদ্ধে। আপনারা সুন্দর বনের ১০ মাইলের মধ্যে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এতো প্রতিবাদ করছেন, মহেশখালীতে পনেরোটা হচ্ছো কোন কিছু বলছেন না কেনো? আমি এখন ধন্যবাদ জানায় তাদের কে সোলতানা কামাল এবং অন্যান্যরা গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, “এটা তো শুধু অমানবিক নয়, বৈষম্যনূলকও বটে!” পার্বত্য চট্টগ্রামে যে কাজটা সরকার করেছিলো ১৯৬০ এর দশকে যে কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সেখানে কী হয়েছে? অন্যদিকে মহেশখালীতে মাত্র ৪ লক্ষ লোক থাকে, ছোট্ট এলাকা। আপনি এটা ধ্বংস করে দিচ্ছেন। কিন্তু কোন প্রতিবাদ করার মানুষ কি পৃথিবীতে নাই? আমি না করতে পারছি প্রতিবাদ, না করে পারছি চুপ করে। আপনার এখানে হয়তো বলছি হয়তো আমি ভুল করছি ধরেন, আমি বিষণ্ণ না হয়ে কোথায় যাবো? আপনি বলুন! এটা কোন ন্যায়বিচারে বলে, সুন্দর বনের ১০ মাইলের মধ্যে হলে সুন্দর বনের ক্ষতি হবে, মহেশখালী কি বাংলাদেশের অংশ নয়? আবার তাও কী সেখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের বদলানোর জন্য কেন্দ্র করছে পাহাড় কেটে। অর্থাৎ একটা জায়গা কে এভাবে বিরানভূমিতে পরিণত করার জন্য মহোৎসব, সেখানে আমি একটু বিষণ্ণও হতে পারবোনা? আচ্ছা ভাগ্যিস মহেশখালীর মানুষরা বুঝতেছেনা, সেখানে তারা জমির ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। আজকে বাংলাদেশে জনসংখ্যা হিসেবে সাক্ষরতা কতো? ধরেন ৭৩%। কিন্তু মহেশখালী তে ববর্তমান সরকারের হিসেবে সাক্ষরতার হার মাত্র ৩০! তাইলে বুঝতে পারেন কত পশ্চাৎপদ এলাকা! সেই এলাকা বলেই কি আপনি সেখানে এ ধরনেরর কাজ! এটা কী ন্যায়বিচার? এখন সরকার প্রধান বলছেন, “যারা উন্নয়ন প্রকল্প কে বিরোধিতা করবেন, আমরা তাদের দেখে নেবো!” যেখানে সরকার প্রধান দেখে নেয়, কোন কথা বলার অধিকার থাকেনা, সেখানে আমি বিষণ্ণ না হয়ে আমার উপায়টা কী? আমি তো হ্যামলেট এর কথা এমনিতে বলিনি, আমিই তো হ্যামলেট! আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, আমি চাই সুস্থধারায় উন্নতি হোক। তাছাড়া সরকার বলছে যেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের আর কোন বিকল্প নাই! কথাটা সত্যি নয়! আচ্ছা, একদিন যখন বিদ্যুৎ এর কারণে করুণ পরিনত হবে তখন কী করবেন? তখন তো আর সংশোধন করার সুযোগ থাকবে না!
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, টকশোতে বলা সলিমুল্লাহ খানের কথার ভিডিও ক্লিপটি টেলিভিশনের প্রকাশের সাথে সাথে তা কপি হয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওটি বিপুল ফেসবুক ব্যবহারকারী টাইমলাইনে শেয়ার করেন এবং ম্যাসেঞ্জারেও শেয়ার করা হয়। এভাবে তা গণহারে ভাইরাল হয়েছে ভিডিওটি। এতে তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা সৃষ্টি হয়। আলোচনার একটই বিষয়টি ‘একদিন বিরান হবে মহেশখালী’।
এই বিষয়টি নিয়ে মহেশখালীর সব ধরণের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এবং আতঙ্ক অনুভব করছে। শুধু তাই নয়; ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার কক্সবাজার সচেতন মানুষগুলো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে।
তারা বলছেন, মহেশখালী কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো শুধু মহেশখালী নয়; পুরো কক্সবাজারকে গ্রাস করে ফেলবে। বিশেষ করে সমুদ্র এলাকাকে মারাত্মক দূষিত করার বিষয়টি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন বোধ করছেন।সিবিএন
পাঠকের মতামত: