নিজস্ব প্রতিবেদক, চকরিয়া ::
কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে নিজের প্রতীকে সিল মারাসহ ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের মারধর, ফাঁকা গুলি করে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা, সড়কের একাধিক স্থানে গাছ ফেলে অবরোধসহ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী কক্সবাজারের চকরিয়ার কৈয়ারবিল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচিত সেই চেয়ারম্যান মক্কী ইকবাল হোসেন এলাকায় বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। তাঁর বাহিনীর সশস্ত্র লোকজন ইউনিয়নের বিভিন্নস্থানে প্রতিপক্ষ প্রার্থীর লোকজনের ওপর চরম বর্বরতা চালাচ্ছেন। কাউকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করছেন, আবার কাউকে এলাকা ত্যাগেরও হুমকি প্রদান করছেন। এমনকি অনেক কৃষকের ফসলের ক্ষেতও গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছেন। তার এসব বর্বরতা থেকে বাদ যাচ্ছেন না বৃদ্ধ মানুষও।
গত রবিবার (২৮ নভেম্বর) ভোটের দিন থেকে অদ্যাবদি এই পরিস্থিতিতে পুরো ইউনিয়নের মানুষ মক্কী ইকবালের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের হাতে জিম্মি হয়ে আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন।
তবে পুলিশ বলছে, কৈয়ারবিল ইউনিয়নে বিজয়ী প্রার্থীর পক্ষ থেকে নির্বাচন পরবর্তী যেসব সহিসংতার ঘটনা ঘটেছে প্রত্যেক অভিযোগের বিশদ তদন্ত চলছে। নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের মারধর, সড়কের বিভিন্নস্থানে গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টির দায়ে সংশ্লিষ্ট প্রিজাইডিং অফিসার কর্তৃক থানায় রুজুকৃত মামলার অন্যতম আসামী চেয়ারম্যান মক্কী ইকবালের ক্যাডার মিজানুর রহমানকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সে ছয় নম্বর ওয়ার্ডের ৬নং ওয়ার্ডের খোঁজাখালী এলাকার কবির আহমদের ছেলে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মুজিবুর রহমান জানান, খিলছাদক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার এ কে এম শাহাবুদ্দীনের দায়ের করা মামলার এজাহারনামীয় আসামীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ তৎপর রয়েছে। বাকী আসামীদের সহসাই গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে। এজন্য স্থানীয়ভাবে সোর্স নিয়োজিত করা হয়েছে। ওই ঘটনায় ১৮ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতসহ ৪৮ জনকে আসামী করে মামলা রুজু করা হয়েছিল।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ওইদিন আশপাশের আরো ৯টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওইসব ইউনিয়নে তেমন কোন বড় ঘটনা না ঘটলেও কৈয়ারবিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রার্থী মক্কী ইকবাল হোসেন যে কোন উপায়ে জিততে তাঁর অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করেছেন কেন্দ্রে। সেই অস্ত্রধারী ক্যাডারেরা ভোটগ্রহণ শুরুর পর থেকে কয়েকটি কেন্দ্রের ভেতর ঢুকে ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ জোরপূর্বক মক্কী ইকবালের ঘোড়া প্রতীকে সিল মারতে বাধ্য করেন। এ সময় ৫ ও ৬ নম্বর কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ চলাকালে মক্কী ইকবালের ক্যাডারেরা সংঘর্ষেও জড়ায়।
ওই ইউনিয়নের চশমা প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আফজালুর রহমান চৌধুরী অভিযোগ করেছেন, মক্কী ইকবালের সশস্ত্র ক্যাডারেরা পাঁচ ও ছয় নম্বর কেন্দ্রের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের জিম্মি করে ঘোড়া প্রতীকে প্রকাশ্যে সিল মারতে বাধ্য করেন ভোটারদের। তাই এই দুই কেন্দ্রে পুনরায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়ে নির্বাচন কমিশন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
এলাকা ছাড়তে হুমকি, সন্ত্রাসী হামলা ও ফসলের ক্ষেত নষ্ট করে দেওয়ার অভিযোগ ঃ
এদিকে নির্বাচন পরবর্তী প্রতিপক্ষের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলা, বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম, ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে দেওয়ার মতো ঘটনা করে যাচ্ছে চেয়ারম্যান মক্কী ইকবালের সশস্ত্র বাহিনীর লোকজন। এতে পুরো ইউনিয়নজুড়ে তার ক্যাডারেরা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
খোঁজাখালী গ্রামের বৃদ্ধ আকবর আহমদ অভিযোগ করেছেন, ঘোড়া প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী মক্কী ইকবাল হোসেনকে আমরা ভোট দিইনি, এমন অজুহাত তুলে অতর্কিত হামলা চালায়। এতে তিনি (আকবর আহমদ) এবং তাঁর দুই পুত্র রক্তাক্ত জখম হয়। হামলায় মক্কী ইকবালের বেশ কয়েকজন কর্মী নেতৃত্ব দেয়। তিনি আরো বলেন, চশমা প্রতীকের পক্ষে কাজ করায় আমাদের ওপর এই হামলা চালানো হয়েছে।
তিনি আরো অভিযোগ করেন, নির্বাচন পরবর্তী এই হামলার ঘটনায় থানায় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেই অভিযোগ মামলা হিসেবে রুজু করা হয়নি। বর্তমানে আমরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছি। এই পরিস্থিতিতে বাড়ির নারী সদস্যরাও আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। ইতোমধ্যে সন্ত্রাসী পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে।
পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের একই গ্রামের কৃষক মুজিবুর রহমান অভিযোগ করেন, তিনি চশমা প্রতীকের পক্ষে কর্মী ছিলেন। এই কারণে ভোট অনুষ্ঠানের পরদিন মক্কী ইকবালের নির্দেশে তার সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা তাঁর প্রায় এক কানি জমিতে রোপিত ক্ষেতের ফসল গুঁড়িয়ে দেয়। এনিয়ে থানা বা কোথাও অভিযোগ করলে পরিণতি ভয়াবহ হবে বলেও শাসিয়ে দেন। এতে জানমালের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় ভূগছি পরিবার সদস্যদের নিয়ে। কোথাও অভিযোগও করার সাহস পাচ্ছিনা। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি, যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
সেই অস্ত্রটি কোথায়, ব্যবহৃত গুলির খোসা কী উদ্ধার হয়েছে?
ভোটের দিন সন্ধ্যায় ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মারধর ও হামলার সময় ব্যবহৃত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রটি এবং সেইদিন মুহুর্মুহ গুলি চালানোর সময় ব্যবহৃত গুলির খোসাগুলো কোথায়? এমন প্রশ্ন রেখেছেন স্থানীয় সাধারণ মানুষ।
তারা বলছেন, নির্বাচন চলাকালে ইউনিয়নের কেন্দ্রে কেন্দ্রে বেশ কয়েকটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি থাকলেও তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার করেছে সে। যদিওবা ভোট অনুষ্ঠানের আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান চালানো হবে। কিন্তু তা মুখের কথাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও স্থানীয়দের ভাষ্যানুযায়ী, ব্যালট বাক্স ছিনতাই চেষ্টা, সড়কে গাছ ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের মারধর, গাড়ি ভাঙচুর, তাদের লক্ষ্য করে ব্যাপক গুলি ছোড়ার ঘটনায় সেদিন তাকে হ্যান্ডক্যাপ পরিয়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিশেষ বাহিনী কর্তৃক আটক করা হয়। এর পর ‘অদৃশ্য শক্তির ইশারায়’ তাকে ছেড়ে দেওয়া হলেও তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি এখন কোথায়। আর ঘটনায় সময় অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহৃত গুলির খোসাও কী উদ্ধার করতে পেরেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং মক্কী ইকবালের সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? এমন সব প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
‘অস্ত্রসহ ধরে ছেড়ে দেওয়া হলো চেয়ারম্যান প্রার্থীকে’ সংবাদে জেলাজুড়ে তোলপাড় :
এদিকে ‘অস্ত্রসহ ধরে ছেড়ে দেওয়া হলো চেয়ারম্যান প্রার্থীকে’ শিরোনামে প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয় পুরো জেলাজুড়ে। এতবড় জঘন্য অপরাধকর্ম করে হাতেনাতে অস্ত্রসহ আটকের পর ‘কোন অদৃশ্য শক্তির’ ইশারায় সে ছাড়া পেয়ে গেল, কেনো তার বিরুদ্ধে কোন মামলাই হলো না! এমন সরব আলোচনা এখন মানুষের মুখে মুখে। অবশ্য গণমাধ্যমের এই সংবাদটি প্রকাশের পর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা সেই দিনে সংঘটিত সকল ঘটনার আদ্যোপান্ত বের করতে তদন্তে নেমেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিও এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কৈয়ারবিলে নির্বাচন পরবর্তী একের পর এক সহিংসতার ঘটনায় তাঁর কাছেও অভিযোগ আসায় অনেকটাই বিব্রত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ। তিনি বলেন, ‘আমি ইতোমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছি, যারাই নির্বাচনের পর শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করবে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে। সেখানে যত বড় প্রভাবশালী ব্যক্তির লোকই হউক না কেন, তা না দেখার জন্যও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
এ ব্যাপারে চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গণি বলেন, ‘নির্বাচন পরবর্তী কৈয়ারবিল ইউনিয়নে কয়েকটি সংঘটিত ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে সেখানে পুলিশের কয়েকটি দল সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। প্রিজাইডিং কর্মকর্তার দায়েরকৃত মামলার এজাহারনামী এবং ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র দেখে ঘটনায় জড়িতদের ধরতে পুলিশ আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। তবে সেদিন বিশেষ বাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ আটকের পর মক্কী ইকবাল ছাড় পেয়ে গেলেও উদ্ধারকৃত অস্ত্রটি কোথায় এবং ব্যবহৃত গুলির খোসা আদৌ উদ্ধার করা গেছে কী-না সেই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে এনিয়ে কোন মন্তব্য করেননি পুলিশ।
তবে অভিযুক্ত চেয়ারম্যান মক্কী ইকবাল হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, তিঁনি এবং তার কোন কর্মী সমর্থক কোন হামলার ঘটনার সাথে জড়িত নন। প্রশাসনকে বিভ্রান্ত করার জন্য এসব উদ্ভট অভিযোগ আনা হচ্ছে তাকে ঘায়েল করতে। তাছাড়া ভোটের দিন কৈয়ারবিলে কোন ঘটনাই ঘটেনি, নির্বাচনী কোন কর্মকর্তাকে মারধর, গাড়ি ভাঙচুর, তিঁনি বা তাঁর কোন কর্মী ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা ও গুলি করার ঘটনার সাথে জড়িত নয়। এর পরও মিথ্যা মামলা রুজু করে তার কর্মীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ বাড়ি বাড়ি অভিযান চালাচ্ছে। অপরদিকে স্থানীয় কাউকে মারধর, ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে দেওয়াসহ কাউকে এলাকা ছাড়তেও হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনার সাথে তিঁনি জড়িত নন। সাংবাদিকদের এমনটাই বলেছেন চেয়ারম্যান মক্কী ইকবাল হোসেন।
পাঠকের মতামত: