ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

চকরিয়া-লামায় ৩৫টি ইটভাটায় বছরে পুড়ছে ২শ’ কোটি টাকার বনের কাঠ

জহিরুল ইসলাম, চকরিয়া ::
চকরিয়ার বনাঞ্চল যেন ইটভাটার জন্য সৃজন করা হয়েছে। ইটভাটার মালিকেরা এখানে প্রতি বছর সরকারী বনাঞ্চলের গাছ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারের জন্য আগাম কিনে নেয়!। মৌসুমের শুরুর আগেই ইটভাটার মালিকেরা লোক নিয়োগ করে বনাঞ্চল থেকে প্রকাশ্যে গাছ কেটে নিয়ে যায় ফাইতং ইটভাটার আশেপাশে। এভাবে প্রতি বছর চকরিয়া, লামার ফাঁসিয়াখালী ও ফাইতংয়ের ৩৫টি ইটভাটায় চকরিয়ার বনাঞ্চল থেকে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকার কাঠ পুড়ছে। এ বছরও ওই একই পরিমানের কাঠ পুড়েছে এসব ইটভাটায়। এসব দেখার কেউ নেই, যারা আছে তারাই বরং বন ধ্বংসকারীদের সহযোগিতা দিচ্ছে। এতে ইটভাটার মালিক, প্রভাবশীলী ব্যক্তি, কতিপয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তার প্রতিনিধি ও বনকর্মীরা লাভবান হলেও এতদাঞ্চলের বনাঞ্চল ন্যাড়া বনভূমিতে পরিনত হচ্ছে।

জানা যায়, চকরিয়ার হারবাংয়ে ৪টি, পাশের লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ও ফাইতংয়ের ৩০টিসহ ৩৫টি ইটভাটা চকরিয়া ও লামার সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘেঁষে এবং ভেতরে গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা। ইটভাটগুলোতে প্রধানত কাঠ পুড়ে ইট তৈরী করা হয়। এসব জ্বালানি কাঠগুলোর বেশীরভাগই চকরিয়া ও লামা বনাঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। ইটভাটায় সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ইটভাটার মালিকেরা ইট পুড়ানোর জন্য মৌসুম শুরুর আগেই জ্বালানি হিসাবে পাশের বনাঞ্চলের গাছ কিনে নেয়। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি, কতিপয় জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা ও বনকর্মীরা যোগসাজস করে জ্বালানি হিসাবে সরকারী বনের গাছ বিক্রি করে দিয়ে থাকে। মৌসুমের সময় বা একটু আগেই ইটভাটার মালিকরা লোক দিয়ে বনাঞ্চলের গাছগুলো কেটে নিয়ে যায়। এলাকাবাসি জানায়, কেটে নেয়া বনের দৃশ্য দেখলে যে কেউ হতবাক হয়ে যাবে। ইটভাটার মালিকরা বনাঞ্চলের গাছের পাশাপাশি ঝুপজঙ্গল, লতাগুল্মসহ সব কিছু কেটে নিয়ে যায়।

বিশেষ করে বানিয়ারছড়া-ফাইতং সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যে সব

এ সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যে সব ব্রীক ফিল্ডের কাঠ যাচ্ছে সে সব ব্রীক ফিল্ড গুলো হল, ফখরুদ্দীনের মালিকানাধীন SBM, নাজেম উদ্দিনের FBM, মহিউদ্দিনেরMBM, নাজু (চুনতি) AMB, দুবাই প্রবাসী রফিক আহমদের ABM, মো.বেলাল উদ্দিনের ABC, মাহমুদুল হকের MBI, ফেরদৌস আহমদের BBC, হুমায়ুন কবির HBM, জামায়াত নেতা আরিফুর রহমান মানিক PBC,আমির হামজা TSB, পেকুয়া ভাইস চেয়ারম্যান মন্জু PBM, মোজাম্মেল হকের EBM, বিএনপি নেতা মোক্তার আহমদের BBM, কবির আহমদের UBM, বশির আহমদের ACB, মোক্তার আহমদ 3BM, গিয়াস উদ্দিনের MMB, জসিম উদ্দিনের SBW, বিএনপি নেতা ফরিদুল আলমের FAC ও HMB ব্রীক ফিল্ডসহ ২৪টির মতো ফিল্ডে জ্বালানী হিসেবে বনের কাঠ ব্যবহার  করেছে বলে অভিযোগ করেছে স্থানীয়রা । ফিল্ডসহ ৩৫টির মতো ফিল্ডের জ্বালানী কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়; বছরে প্রতি ইটভাটায় জ্বালানি হিসাবে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার মন লাকড়ী বা জ¦ালানী কাঠ লাগে। সে হিসাবে চকরিয়া ও লামার ফাইতংয়ে ৩৫টি ইটভাটায় প্রতি বছর ১২লাখ ২০ হাজার মন থেকে ১৩লাখ ৮০ হাজার মন লাকড়ীর প্রয়োজন হয়। প্রতি মন লাকড়ীর স্থানীয় মূল্য ১৮০ টাকা থেকে ২শত টাকা পর্যন্ত। এভাবে ওই ৩৫টি ইটভাটায় প্রতি বছর প্রায় ২ শত কোটি টাকার উপরে কাঠ পুড়ছে। চকরিয়ার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নের সাহাব উদ্দিন জানান; কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের নলবিলা বিটের অধীনের কাকারা মৌজার খেদারবান এলাকায় তার দখলে ৪ একর সরকারী বনভূমি আছে। ওই বন ভূমিতে ঘন গাছ ছিল। গাছগুলো তিনি ফাইতংয়ের এক ইটভাটাসহ বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করে দিয়েছেন। তার পাশের আরো এক ব্যক্তি এ বছর ৫০লাখ থেকে ৬০লাখ টাকার বনের কাঠ বিক্রি করেছে। এসব কাঠগুলো লামার ফাইতংয়ের ইটভাটার মালিকেরা বন থেকে কেটে নিয়ে গেছে। এসব বনভূমি এখন ন্যাড়া হয়ে গেছে।
এলাকাবাসি জানায়, চকরিয়ার বিএনপি নেতা ফরিদ কন্ট্রাক্টারের ভাই জালাল উদ্দিন লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামীলীগ নেতা!। সেই সুযোগে প্রভাব খাটিয়ে তিনি বনের গাছ কেটে ইটভাটায় নিয়ে গেলেও কেউ বাধা দিতে সাহস করে না। চকরিয়া ও লামার ফাইতংয়ের বেশীরভাগ ইটভাটার মালিক বিএনপি জামাত সমর্থিত হলেও তারা স্থানীয় আওয়ামীলীগ নাম ধারী কিছু ব্যক্তির ছত্র ছায়ায় থাকায় পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ডে যুক্ত হয়েও পার পেয়ে যাচ্ছে। চকরিয়ার সামাজিক বনায়নের বেশীরভাগ গাছ জোর করে কেটে ইটভাটায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সামাজিক বনায়নের উপকারভোগীরা অভিযোগ করার পরও গাছ লুটেরাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা হচ্ছে না।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়; কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের নলবিলা বিট, রিংভং (ফাঁসিয়াখালী) বিট, ডুলাহাজরা বিট, মানিকপুর বিট, কাকারা বিট ও চট্টগ্রাম দক্ষিণ বনবিভাগের চুনতি রেঞ্জের বরতইতলী, হারবাং বিটের বেশীর বনাঞ্চল উজাড় হয়ে গেছে। এসব এলাকায় সামাজিক বনায়নের গাছও রক্ষা করা যাচ্ছে না। সামাজিক বনায়নের গাছও জোর করে কেটে ইটভাটায় নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুল মতিন বলেছেন; বনের গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি তদন্ত করে সত্যতা পেয়েছেন। নলবিলা বিট অফিসের এক কর্মকর্তা জানান; তার বিটের খেদারবান এলাকার গাছগুলো ফাইতংয়ের ইটভাটায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কাকারার পাহাড়ী এলাকায় একটি রুট তৈরী করেছে। ওই রুট দিয়েই গাছগুলো ফাইতংয়ের ইটভাটার দিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন বলে জানান। এ ব্যাপারে অবিলম্বে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে জোর দাবী জানিয়েছেন এলাকার পরিবেশবাদী জনগন।

পাঠকের মতামত: