ঢাকা,শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪

কুমিল্লার দর্শনীয় স্থান বার্ড-সমবায় একাডেমী-শালবন অপরূপ দৃশ্যের সমাহার

সেলিম উদ্দিন, কোটবাড়ী কুমিল্লা থেকে:

শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান কুমিল্লা। নানা কারনেই এ জেলায় রয়েছে অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার পাশাপাশি পর্যটনের ক্ষেত্রেও রয়েছে ব্যাপক সম্ভাবনা। সারা বছর দেশ-বিদেশ থেকে আসা হাজার হাজার পর্যটকের আগমন ঘটে কুমিল্লার দর্শনীয় স্থানগুলিতে। এক কথায় প্রাকৃতিক সম্পদ আর নয়নাভিরাম দৃশ্যের অপূর্ব সমাহার কুমিল্লা। অসংখ্য প্রাকৃতিক ও প্রতœসম্পদ নিদর্শনসমৃদ্ধ নয়নাভিরাম অপরূপ দৃশ্যের সমাহারে বিস্তৃত কুমিল্লার বার্ড-সমবায় একাডেমী ও শালবন বিহারের এমনতর চিত্র দেখা গেছে গতকাল সোমবার (১৩ নভেম্বর) ঐতিহাসিক এসব এলাকা ঘুরে।

কুমিল্লা শহর থেকে মাত্র ৮/৯ কিলোমিটার পশ্চিমে ময়নামতি কোটবাড়ি। এখানে অষ্টম শতকের পুরাকীর্তি রয়েছে। এখানকার বিভিন্ন স্পটের মধ্যে শালবন বিহার, নব শালবন বিহার ও বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। শালবন বিহার দেখার পর প্রায় ৫ কিলোমিটার উত্তরে দেখবেন কোটিলা মুড়া। এখানে তিনটি বৌদ্ধ স্তুপ রয়েছে। কোটিলামুড়া দেখার পর এটি থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সেনানিবাস এলাকায় অবস্থিত চারপত্র মুড়া। প্রায় ৩৫ ফুট উঁচু একটি ছোট ও সমতল পাহাড়ের চূড়ায় এর অবস্থান। পাহাড়পুর বিহারের পরই এর স্থান। এছাড়াও রয়েছে রূপবান মুড়া। রয়েছে ময়নামতি যাদুঘর,কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ।

বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বার্ড:

কুমিল্লায় রয়েছে উপমহাদেশের সমবায়ের অন্যতম পৃথিকৃত মরহুম আকতার হামিদ খানের স্মৃতি বিজড়িত বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বার্ড। বার্ডের ভিতরে পাহাড়ের মাঝখানে দেখতে পাবেন অনিন্দ্য সুন্দর বনকুটির, নীলাচল পাহাড়। নির্জন প্রকৃতির এক অকৃত্রিম ভালো লাগার জায়গা হচ্ছে এ নীলাচল। পুরো বার্ডের সবুজের সমারোহ। রয়েছে পাখির কিচির-মিচির আওয়াজ। আমরা অনেকেই ময়নামতি শালবন বিহার বেড়াতে গেলে বার্ড এ যাই। অনেকে আবার মনে করে সরকারী অফিস ভেতরে গিয়ে কি হবে? অনেকে আবার সামনে ঘুরে চলে আসেন। ফলে পেছনের সৌন্দর্যটা আমাদের অজানা থেকে যায়। এখন খুব ভালো সময় আবাহনে সবুজে সবুজে চেয়ে আছে বার্ড এর প্রতিটি কোণ।

কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে বার্ড একটি পিকনিক স্পট ও বিনোদন কেন্দ্র। এখোনে রয়েছে পিকনিক ও বিনোদনের সব ব্যবস্থা ভেতরে রয়েছে পাহাড় ও নানারকম গাছগাছালি। বাইরে থেকে বোঝাই যায়না ভেতরে একটি সুন্দর বোটানিক্যাল গার্ডেন আছে। রয়েছে কয়েকটি টিলা। এখানকার নীলাচল পাহাড় আপনাকে বার বার টানবে ওখানে যাওয়ার জন্য। আছে বনমালঞ্চ নামে একটি সুন্দর ভিআপি পিকনিক স্পট। ভেতরে সারাদিন ঘুরে বেড়ানো ও খেলাধুলার জন্য রয়েছে প্রচুর পরিমাণ জায়গা। মনে হবে এ একটা আনন্দরাজ্য।

কর্পোরেট জগতের জন্য বার্ড হলো একটি সুন্দর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে ২০০টি সিট রয়েছে। একসাথে অনুষ্ঠান চলতে পারে কয়েকটি হলরুমে। আছে ক্লাসরুম ও ট্রেনিং সেন্টারের সব ব্যবস্থা। এখানে ৩টি ভালো মানের ক্যাফটেরিয়া রয়েছে। যেখানে সুলভ মূল্যে পুষ্টিকর খাবার পাওয়া যায় সারাদিন। এছাড়া রয়েছে ৪ টি কনফারেন্স কক্ষ, ১ টি গ্রন্থাগার ও ১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

বার্ড এর আরেকটি আকর্ষণ হলো এর পারিপাশ্বিক পরিবেশ। উচু নিচু পাহাড়ের গা ঘেষে নানা গাছগাছালি। প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার লোক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে ঘুরে দেখতে আসে। প্রতবিছর সারাদেশ থেকে লাখো লাখো শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন কোম্পানীর এজিএমসহ নানা প্রশিক্ষণে এখানে আসে হাজার হাজার কর্মকর্তা কর্মচারী।

মূলত সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বার্ড যাত্রা শুরু করলেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রশিক্ষণ এবং তৃণমূল পর্যায়ের লোকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

বার্ডে প্রবেশের জন্য কোনো টিকেট নেই। তবে রাতে থাকার জন্য প্রতি রুমের ভাড়া ৫০০ টাকা। প্রতি রুমে ২টি করে বেড রয়েছে। আর হলরুমর ভাড়া ১০ হাজার থেকে ৪০ হাজার পর্যন্ত। এছাড়া ভিআইপি পিকনিক স্পট এর জন্য আলাদা ভাড়া দিতে হয়। মাঠে খেলাধুলা বা অন্য কিছু এমন কি ঘুরে দেখার জন্য কোনো পয়সা দিতে হয়না।

যতটুকু জানতে পেরেছি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী বার্ড ১৯৫৯ সালের ২মে একটি প্রশিক্ষণ, গবেষণা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। সূচনালগ্নেই একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ড. আখতার হামিদ খানের নেতৃত্বে নিবেদিত প্রাণ কিছু গবেষক গ্রামীণ জনগণের সাথে নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে এ দেশে পল্লী উন্নয়নের উপযোগী কিছু মডেল কর্মসূচী উদ্ভাবন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে ষাটের দশকে গ্রামাঞ্চলে বিরাজিত সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। এসব কর্মসূচীর মধ্যে অগ্রাধিকার প্রাপ্ত বিষয়গুলোর মধ্যে গ্রামে টেকসই সংগঠন সৃষ্টি, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত পুঁজি সৃষ্টি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, উন্নত কৃষি প্রযুক্তি সম্প্রসারণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, মহিলা শিক্ষাসহ সমাজ উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের প্রসার, গ্রামের সর্বস্তরের জনগণের সহযোগিতায় একটি সংগঠিত গ্রাম সমাজ সৃষ্টি, অকৃষি খাতে ভূমিহীন শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান, গ্রামের সাথে বহির্বিশ্বের কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন এবং সরকারের সেবা গ্রামে পৌছানোর কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন। এই ৯টি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত বিষয়কে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের জন্য একাডেমী ষাটের দশকেই সমন্বিতভাবে কার্যক্রম গ্রহণ করে।

বার্ড স্থানীয় সরকার, পল্লী ‍উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে বার্ড পরিচালিত হয় যার সভাপতি হলেন স্থানীয় সরকার পল্লী ‍উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী। মহাপরিচালক একাডেমীর প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন যাকে একজন অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও ৯ জন পরিচালক সহায়তা প্রদান করে থাকে। একাডেমীর সমস্ত কর্মকান্ড নয়টি বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে যার প্রধান হিসেবে একজন করে পরিচালক দায়িত্ব পালন করেন। পল্লী উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বার্ড ১৯৮৬ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ লাভ করে। বার্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ৩৬৫জন।

বাংলাদেশ সমবায় একাডেমী:

সমবায় অধিদপ্তর এর নিয়ন্ত্রণাধীন সর্বোচ্চ এবং জাতীয় পর্যায়ের একমাত্র প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের আওতায় সমবায় অধিদপ্তর একটি সংযুক্ত দপ্তর। কুমিল্লা জেলা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কোটবাড়ীতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমীর সাথে একই ক্যাম্পাসে এর অবস্থান। কোটবাড়ী খুবই ঐতিহাসিক এক স্থান। বৌদ্ধ সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন শালবন বিহার এখানেই অবস্থিত। এই শালবন বিহার আজ থেকে প্রায় ১২০০ বছর আগে জ্ঞান-অর্জনের এক পাদপীট ছিল এই কোটবাড়ী। ১২০০ বছর পরও কোটবাড়ী শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের এক অন্যতম স্থান হিসেবে দেশ ও বিদেশে সমানভাবে খ্যাত। এরকম একটি ঐতিহাসিক স্থানে অবস্থানের জন্য নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ সমবায় একাডেমী গৌরব বোধ করে।

বাংলাদেশ সমবায় একাডেমী’র অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জণ করার জন্য সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে হয়। এর মধ্যে প্রধান কাজ হলো প্রশিক্ষণ প্রদান। সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সমবায় অধিদপ্তরের আওতায় নিবন্ধিত সমবায় সমিতির সদস্যদের প্রশিক্ষণ সুবিধা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ সমবায় একাডেমী এবং এর আওতাধীন ১০টি আঞ্চলিক সমবায় ইনষ্টিটিউট বিগত কয়েক দশক যাবৎ নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

প্রশিক্ষণ কাজ সুষ্টুভাবে পরিচালনার জন্য সমবায় একাডেমীতে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা বিদ্যমান। যেহেতু একাডেমীর সকল প্রশিক্ষণ আবাসিক সেজন্য প্রশিক্ষণার্থীদের আবাসনের জন্য রয়েছে দুটি তিনতলা হোষ্টেল ভবন যেখানে প্রায় ১০০ জন প্রশিক্ষণার্থী একত্রে বাস করতে পারে। একাডেমীতে রয়েছে ১০হাজার এর বেশী পুস্তক-সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরী। লাইব্রেরীতে বিভিন্ন রকমের বই আছে যেগুলোর মধ্যে একাডেমীক বই ছাড়াও সমসাময়ীক সময়ের জন্য প্রয়োজন হয় এমন বইও রয়েছে।

পাঠকের মতামত: