ঢাকা,বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

কঠিন অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি দেশ

পীর হাবিবুর রহমান 

একের পর এক ঘটনা ঘটছে। আগের লেখায় লিখেছিলাম সবাই সংযত হোন, আর ওয়ান-ইলেভেন চাই না।pir habibur ra

কিন্তু সংযত হওয়ার কোনো আলামত দেখা যায়নি। পরিস্থিতি এক সপ্তাহে আরও অগ্নিগর্ভ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ মুখোমুখি থেকে মারমুখী অবস্থান নিয়েছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় সরকার ও সরকারি দলকে যতটা না সংক্ষুব্ধ করেছে,  তার চেয়ে বেশি রায়ের পর্যবেক্ষণ মন্তব্য প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করেছে।   প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ছাড়া সরকার পক্ষের কেউ সাংবিধানিক, পরিমার্জিত, পরিশীলিত রাজনৈতিক বক্তব্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছেন না। সারি সারি মন্ত্রী, ছোট-বড় সব নেতাই আক্রমণাত্মক ভাষায় প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ চাইছেন। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আদালতের বাইরে এ রায় নিয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলেছেন। কিন্তু আদালতে দাঁড়িয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে উদ্দেশ করে যেভাবে কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, তাতে বাইরের পরিস্থিতি আরও অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে।

সরকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রধান বিচারপতির পক্ষে অবিরাম কথা বলছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, রুহুল কবীর রিজভীসহ আরও অনেকে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক এস কে সিনহা, তার রায় ও পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে মোটা দাগে বক্তব্য দিতে গিয়ে আগুনে ঘি ঢেলেছেন। প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে এক সময় আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সামসুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী মানিক আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে গিয়ে সরকারি দলের অনেকেরই সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। সরকার পক্ষের জন্যই তিনি মুখ বন্ধ করেছিলেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে তিনি তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলতে পারছেন, সেদিন তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন; সেটিই আজ সত্য হয়েছে। সরকার এখন তার কথারই প্রতিধ্বনি করছে। বিচারপতি মানিক বলেছেন, এস কে সিনহাকে প্রধান বিচারপতির আসন থেকে এখনই সরিয়ে না দিলে তার মেয়াদের বাকি পাঁচ মাসের মধ্যে বড় অঘটন ঘটতে পারে। সরকারের তরফ থেকে প্রধান বিচারপতির ওপর সরে দাঁড়ানোর চাপটা যে সংঘবদ্ধভাবে করা হচ্ছে, দলের সব পর্যায় থেকে নেতা-কর্মীরা যেভাবে বক্তৃতা করছেন; তাতে এটি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

পরিস্থিতি এরকম যে, প্রধান বিচারপতি সরে না দাঁড়ালে সরকারের জন্য যেমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা সম্ভব নয়, তেমনি প্রধান বিচারপতির জন্যও সরকার এখন সুখকর বিষয় নয়। নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের টানাপড়েন থেকে বারুদের মতো জ্বলে ওঠা পরিস্থিতি যে সংকট তৈরি করেছে, তার সমাধান কখন, কোথায়, কীভাবে হবে সেটি কেউ বলতে পারছেন না। গভীর উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার মধ্যে একের পর এক দৃশ্যপট, বিতর্ক পর্যবেক্ষকরা পর্যবেক্ষণ করছেন।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা রবিবার আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেলকে সতর্ক করতে গিয়ে কড়া হুঁশিয়ারিই উচ্চারণ করেননি, এমন উদাহরণ টেনে এনেছেন যাতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার ও তার অনুসারী সমর্থকদের বাইরেও পাকিস্তানবিরোধী মানুষের কলিজা বিদীর্ণ করে আত্মায় লেগেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রশ্নের ঝড় বইছে। প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন, পাকিস্তানে তো বিচার বিভাগ প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছে। কই সেখানে তো কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। তো এখানে রায় নিয়ে এত হইচই কেন? প্রশ্ন উঠেছে, উদাহরণই যদি টানবেন, তাহলে পাকিস্তান কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই টানতে পারতেন। আমেরিকার ফেডারেল আদালত কীভাবে একের পর এক নির্বাহী আদেশ বাতিল করেছে, কিন্তু উচ্চবাচ্য হয়নি।

যে পাকিস্তান এ দেশে গণহত্যা চালিয়েছে, যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এ দেশের মুক্তিকামী জনগণ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পরাজিত করে বীরত্বের সঙ্গে বিজয় অর্জন করেছে; সেই পাকিস্তান কেন? বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন সমাজের চেতনাবোধ থেকে। সেই লড়াই এখনো চলছে। অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ, ধর্মান্ধতা ও সামরিক তন্ত্র ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের ঐতিহ্য। জাতিগত চেতনাবোধের জায়গা থেকে দুটি রাষ্ট্রের অবস্থান দুই বিপরীত মেরুতে। পাকিস্তানের বিচার বিভাগের ও সরকারের ক্ষমতার উত্স ক্যান্টনমেন্ট। এ দেশে ক্ষমতার উত্স জনগণ। পাকিস্তানে কী সরকার, কী বিচার বিভাগ সবার ক্ষমতার উত্সই ক্যান্টনমেন্টের বন্দুকের নল। সেখানকার দুর্বল গণতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে বিচার বিভাগ বরখাস্ত করেছে ক্যান্টনমেন্টের শক্তিবলে।

এখানে জনগণের আবেগ, অনুভূতি, চিন্তা-চেতনাকে রাষ্ট্রের কোনো বিভাগ কী নির্বাহী বিভাগ, কী আইন বিভাগ, কী বিচার বিভাগ অস্বীকার করতে পারেন না। সংবিধান, আইন জনগণ যেরকম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্তির উত্স, তেমনি বিচার বিভাগের শক্তির উত্সও সংবিধান, আইন ও জনগণ। যুগে যুগে এই জনপদে জনগণের শক্তির কাছে বহু অশুভ শক্তি, বহু অগণতান্ত্রিক শক্তি, বহু সাম্প্রদায়িক শক্তিই নয়, খোদ সামরিক শক্তিতে শক্তিশালী ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তানও বাঙালির বীরত্বের কাছে পরাস্ত হয়েছে।

আমাদের দেশে জনগণ এখন বন্যার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। সরকার বলছে, বন্যায় ঘরহারা মানুষকে ঘর দেবে, খাবার দেবে, চিকিত্সা দেবে। মানুষের মধ্যে মানবিক শক্তি জেগে উঠেছে। দাবি উঠেছে সব ধর্মীয় উত্সব থেকে শুরু করে সামাজিক উত্সবের জৌলুস, খরচ কমিয়ে বানভাসি মানুষের সেবায় হাত বাড়াতে। ধর্ষণের মহোত্সব দেখা দিয়েছে দেশে। এই ধর্ষকদের প্রতিরোধের ডাক উঠেছে সমাজের সব স্তরে। ইয়াবাসহ মাদক সাম্রাজ্যের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। নতুন প্রজন্মকে মাদকের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে মুসলিম দেশ মালয়েশিয়ার মতো না হলেও অন্তত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য বিয়ার ওপেন করে দেওয়ার চিন্তা অনেকের কাছ থেকে উত্সারিত হচ্ছে। একটি সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের শিকার হচ্ছি আমরা।

যুগে যুগে অনেক পেশাদার, দক্ষ কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হককে ব্যক্তিগতভাবে আমরা অনেকেই চিনি। একজন পেশাদার, দক্ষ, পরিশ্রমী, আপাদমস্তক সৎ, জুডিশিয়ারি থেকে আসা নিরাবরণ, সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত গণমুখী মানুষ তিনি। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আটকে দিতে হবে কেন? এটা বুঝি না, রহস্যজনক ঘটনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে মাননীয় প্রধান বিচারপতি বঙ্গভবনে আছেন তৃণমূল রাজনীতি থেকে উঠে আসা গণমুখী রাজনীতির পরীক্ষিত মানুষ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ জীবনের উত্থান-পতন, গণতন্ত্রের সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, উগ্রতা, হঠকারিতা, উন্নাসিকতা, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও অন্ধকার পথ ধরে আসা অশুভ শক্তির আগমনে সবার পরিণতি আমাদের চেয়ে আপনাদের বেশি ভালো জানা। সব উদাহরণ বাদ দিলেও জাতির জীবনে আসা ওয়ান-ইলেভেন দুটি রাজনৈতিক শক্তির বা দুটি রাজনৈতিক জোটের সংহিস সংঘাতময় পরিস্থিতির ওপর ভর করে এসেছিল। সেই শক্তি গোটা সমাজ ও রাজনীতিকে, অর্থনীতিকে অস্থির, অশান্তই করেনি; বিশ্বাস, আস্থার জায়গা শেষ করে দিয়ে গেছে।

সেদিন দেশের জনগণসহ আমরা অনেকেই সেই ওয়ান-ইলেভেনকে ও কুশীলবদের দেখানো সংস্কারের স্বপ্নগুলোকে সমর্থন করেছিলাম। আজকাল সেই ওয়ান-ইলেভেনের সমর্থক সবাই নিজেদের ভোল রাতারাতি পাল্টে ফেলেছেন। ওয়ান-ইলেভেন ব্যর্থ হওয়ার কারণেই তারা সেদিন যে ভাষায় কথা বলেছিলেন, আজ তার উল্টো ভাষায় কথা বলছেন। ওয়ান-ইলেভেন মানেই আমি এককথায় বলি, বড় ভাই ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন আইন ও তথ্য উপদেষ্টা, জীবনে মদ স্পর্শ না করে ছোট ভাই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মদের মামলায় দেশান্তরী হন। দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, প্রান্তিকের রাজনৈতিক কর্মী সবার ওপরই এক কঠিন দমন-পীড়ন নেমেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে দেখা দেওয়া প্রতিবাদের ঝড় শেখ হাসিনার একক নেতৃত্বের সাহসী চ্যালেঞ্জ ও জনগণের মধ্যে ঘটে যাওয়া গণঅসন্তোষের কারণেই তাদের পরাজিত হতে হয়েছে। মাঝখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ। অনেক রাজনীতিবিদ, সমাজের অনেক আলোকিত মানুষ হয়েছেন প্রশ্নবিদ্ধ। ঘটেছে তাদের ক্যারিয়ারে বিপর্যয়। প্রমাণিত হয়েছে দেশের মানুষ দুই নেত্রীর পক্ষে আছেন।

মাঝখানে ২০০৮ সালের নির্বাচনে গণরায় নিয়ে শেখ হাসিনা নিজস্ব ক্যারিশমায় ও ইমেজে দল এবং জোটকে ক্ষমতায় নিয়ে এলে সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদীরা বেনিফিশিয়ারি হয়েছেন। সেই ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবরা হয়েছেন খলনায়ক। যে বিএনপি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল, তারা আজ অভিশাপের যন্ত্রণা ভোগ করছে। যেই ইয়াজউদ্দিন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা হয়েছিলেন, তিনিও ইতিহাসে নিন্দিত হয়েছেন। জনগণের সামনে আগামীতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের হাতছানি। সেই নির্বাচন ঘিরে নির্বাচন কমিশন যে সিরিজ মতবিনিময় সভা করছে সেখানে ১৬ আগস্ট সকালে নিমন্ত্রণ পেয়েও যাইনি। আমাকে নিমন্ত্রণ না করলেও তাদের কিছু এসে যেত না। কিন্তু আমার না যাওয়ার কারণ, নির্বাচন কমিশনের ওপর আমার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো আস্থা নেই। নির্বাচন কমিশনের সবাইকে আমার বরাবর অবসর জীবনের বা কর্মকালীন সময়ের বাড়তি চাকরিজীবীই মনে হয়।

পাশের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের নির্বাচন কমিশনের মতো একটি শক্তিশালী স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা নির্বাচন কমিশনকে গড়তে পারিনি। কিন্তু আমাদের ৪৬ বছরের ইতিহাস বলছে, নির্বাচন কমিশন মানুষ না আসা সামরিক শাসকদের প্রহসনের ‘হ্যাঁ’, ‘না’ গণভোটই সম্পন্ন করে দেয়নি; অসংখ্য মিডিয়া ক্যুর নির্বাচন করে দিয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ইতিহাসের বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর খুনি মোশতাককে ব্যালট বাক্স ঢাকায় এনে বিজয়ী করতেই সফল হয়নি, বিশ্ববাসীর সামনে মাগুরা উপনির্বাচনের গণরায় ছিনতাইয়ের বিতর্কিত নির্বাচনেও ভোট ডাকাতকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। একটি উপনির্বাচন, একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি সরকারকে বিদায় করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ১৯৮৮ সালের একতরফা নির্বাচন, ১৫ ফেব্রুয়ারি ও ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে সম্পন্ন করে দিয়েছে। মানুষ আসুক বা না আসুক, কোনো রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করুক বা না করুক, মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা সেটি তৃপ্তির সঙ্গে সম্পন্ন করে বেশরমের মতো পুরস্কৃত হয়েছেন।

কিন্তু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় সেই সংসদগুলো চতুর্থ, ষষ্ঠ এবং দশম সংসদ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বিরোধী দলের বর্জন, প্রতিরোধের ব্যর্থতা ও সরকারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে না পারার কারণে সরকার সেটি হজম করে নিতে পেরেছে। এখন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় দেশ দুর্বল হলেও গণতন্ত্রের পথে হাঁটছে। সামরিক শাসন কবলিত বাংলাদেশ দীর্ঘ আন্দোলন-লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে একদলীয় শাসন, সেনাশাসন কিংবা সেনাসমর্থিত স্যুট-টাই পরা গণবিচ্ছিন্ন সুশীলের ওয়ান-ইলেভেন শাসন গ্রহণযোগ্য নয়। যত ভঙ্গুরই হোক, যত দুর্বলই হোক, যত প্রশ্নই থাকুক সংসদীয় গণতন্ত্রই এই জাতির আরাধ্য শাসন ব্যবস্থা। সংসদীয় গণতন্ত্রে শক্তিশালী সরকার ও বিরোধী দলের পাশাপাশি কার্যকর সংসদ ও শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান মানুষের প্রত্যাশা। যে প্রত্যাশার ওপর, যে সংগ্রামের ওপর বিচার বিভাগ স্বাধীনতা লাভ করেছে, গণতন্ত্র সেনাশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়েছে। সেখানে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করাই বড় চ্যালেঞ্জ। আগামী নির্বাচন যাতে গ্রহণযোগ্য হয়— এ বিষয়ে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।

এ দেশে যতগুলো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে ’৭০ সাল থেকে, ’৭০-এ ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কারণে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত করেছিল। সেদিনও দলের অভ্যন্তরে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারা লালনকারীরা নির্বাচন নয়, সশস্ত্র যুদ্ধে স্বাধীনতার দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু একজন সাংবিধানিক রাজনীতির গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দৃশ্যমান নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু ভোটকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, হঠকারী পথ নেননি। আওয়ামী লীগ রাজনীতির ইতিহাসে কোনো নির্বাচনই বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়নি। মওলানা ভাসানীর অনুসারীরা ভোটের বাক্সে লাথি মারতে মারতে নেতাকেও শেষ করেছেন, নিজেরা নিঃশেষ হয়ে পরবর্তীতে সামরিক শাসকদের দাসত্ব করেছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন বিএনপির জন্য কতটা আত্মঘাতী সেটি দলের নেতারাও মর্মে মর্মে টের পাচ্ছেন। এটি বলতে গেলেই দলকানারা ব্যর্থতার যন্ত্রণা নিয়ে গালি দেন।

প্রতিটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই সফল হয়েছে নির্বাচনকালীন সরকারের ইচ্ছার ওপর। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা বিএনপি নেত্রীকে আলোচনায় ডেকেছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ অনেক মন্ত্রণালয় দিতে চেয়েছিলেন। বিএনপি কোন অন্ধকার শক্তির ফাঁদে পড়েছিল, তা তারাই জানে। একটি স্বাধীন দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করার দায় এ কারণে তারাও এড়াতে পারে না। দেশ যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জেগে ওঠে তখনো বিএনপি জামায়াতে ইসলামী দলকে ছাড়তে পারে না।

আজকের চলমান পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির রায় ও নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে দৃশ্যমান বিরোধ বিএনপির কাছে ঈশ্বরের কাছাকাছি জায়গায় চলে গেছেন এস কে সিনহা। অন্যদিকে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দিয়ে আজকের সংকটে সরকারের পক্ষে ওকালতি করে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে বেনিফিশিয়ারি সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বিএনপির কাছে শয়তানের চেয়েও নিকৃষ্ট। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কাছে তিনি ফেরেশতার কাছাকাছি চলে এসেছেন। কোনোটাই গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক শাসন ব্যবস্থার জন্য শুভ নয়। নির্বাহী বিভাগ হোক, বিচার বিভাগ হোক, কারও চেয়ারই চিরস্থায়ী নয়। দেশ, জনগণ চিরস্থায়ী। সংবিধান ও আইন মানুষের কল্যাণে নিরন্তর পরিবর্তনশীল। এমনি পরিস্থিতিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আমাদের আবেদন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিবেদন এবং প্রধান বিচারপতির কাছে সবিনয় অনুরোধ আমাদের দেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। মনে হচ্ছে, এক অগ্নিপরীক্ষার মুখোমুখি আমাদের সাংবিধানিক রাজনীতি। রাষ্ট্রপতির মধ্যস্থতা জরুরি। প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রী-নেতাদের সংযত করা জরুরি, প্রধান বিচারপতিরও উপলব্ধি করার বিষয়—এটা বিপ্লবের বিষয় নয়। এখানে কোনো ব্যক্তি নন, রাষ্ট্রের একেকটি স্তম্ভের প্রধান আপনারা। বিরোধী দলের মধ্যে এক ধরনের উল্লাস চলছে, প্রধান বিচারপতি সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। এই সংসদের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিয়েছেন। যে কোনো প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের যে কোনো অঙ্গ দুর্বল থাকলে দায়িত্বশীল সবারই উচিত সেটি শক্তিশালীকরণ।   কেউ সংবিধান বা জনগণের চেয়ে বড় নন। জনগণের আকাঙ্ক্ষা সংবিধানের পথ হারিয়ে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্যুত হয়ে রক্ষা করা সম্ভব নয়।   গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারাই এই বিতর্ক, এ সমস্যার সমাধান সবাইকে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সমাধান টানার সময় এখন। ইশান কোণে মেঘ জমার আগেই, অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

পাঠকের মতামত: