উপজেলা সংবাদদাতাদের নামে সম্মানী ভাতা উত্তোলন করে সরকারি টাকা আত্মসাৎ, দেড় বছর আগে চাকরি ছেড়ে দেয়া শিল্পীর স্বাক্ষর জাল করে সম্মানী ভাতা উত্তোলন, নিয়মিত ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি, কথায় কথায় চাকরিচ্যুত করার হুমকি, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্ব্যবহারসহ ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে বাংলাদেশ বেতার কক্সবাজার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক মো: হেমায়েত আকবর টিপুর বিরুদ্ধে। এমনকি সংবাদ প্রচারের নামে সরকারের অন্তত দশ লাখ টাকা অপচয়েরও অভিযোগ এসেছে বেতারের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
শুধু তাই নয়, সংবাদদাতাদের বেতন বকেয়া রেখে দেয়া, সংবাদাতাদের পাঠানো সংবাদ প্রচার না করে বাসি সংবাদ প্রচার, ভুয়া বিল ভাউচার করে অনিয়মিত শিল্পীদের নামে সম্মানী ভাতা উত্তোলন, গাড়ী ব্যবহার না করে জ্বালানী তেলের টাকা আত্মসাৎ, উপজেলায় কর্মরত বেতার সংবাদদাতাদের নামে অতিরিক্ত সম্মানী ভাতা উত্তোলন করে আত্মসাৎ, বেতার অফিসে কর্মরত নেই এমন অস্থায়ী কর্মচারীদের নামে বেতন ভাতা উত্তোলন, সংবাদ পাঠক/পাঠিকাদের সম্মানী ভাতা আত্মসাৎ করাসহ আরো দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিকার চেয়ে বেতারের উপজেলা সংবাদদাতা এবং একজন ভুক্তভোগী নারী কর্মচারী বাংলাদেশ বেতারের মহা-পরিচালক বরাবর লিখিত আবেদন জানিয়েছিলেন।
হেমায়েত আকবর টিপু ২০১২ সালের জানুয়ারী মাসে কক্সবাজার বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি দুর্নীতির ফাঁদ পাতেন। দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্ব পালনকারী কর্মচারীদের বিভিন্ন কৌশলে তাড়িয়ে দিয়ে তাদের নামে বেতন ভাতা উত্তোলন করেন।
হুরী জান্নাত নামে এক সংবাদ সাপোর্ট কর্মী বেতারের মহা পরিচালকের বরাবর লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, এসিএন টিপু তাকে দায়িত্বের বাইরে অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করতেন। দায়িত্বের বাইরে কাজে চাপ প্রয়োগ করলে অপারগতা প্রকাশ করায় বিগত ০৫/১১/২০১৩ ইং তারিখে তার কাছ থেকে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্র নেন।
তবে, বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট গোপন রাখেন টিপু। পরবর্তীতে স্বাক্ষর জাল করে সোনালী ব্যাংক থেকে সম্মানী ভাতা উত্তোলন করেন। পদত্যাগের ৮ মাস পরে আরো ১ হাজার টাকা বাড়িয়ে ভুয়া সম্মানী ভাতা তুলতে থাকেন।
তার হিসেব মতে, মাসিক সাড়ে ৩ হাজার টাকা হারে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাস থেকে ২০১৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত এই ৮ মাসে ২৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছেন হেমায়েত আকবর টিপু।
এছাড়া ১ হাজার টাকা সম্মানী ভাতা বৃদ্ধি করে ২০১৪ সালের জুলাই মাস থেকে ভুয়া বিল ভাউচার বানিয়ে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করছেন।
এসব বিষয়ে জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে তদন্ত করলে সঠিকটি বেরিয়ে আসবে বলেও জানান অভিযোগকারী হুরী জান্নাত।
তবে এখানে আশ্চর্যের বিষয় হলো, দৈনিক হাজিরা খাতায় হুরী জান্নাতের কোন স্বাক্ষর নাই। পদত্যাগ করার পরও কিভাবে তার নামে বেতন ভাতা উত্তোলন করলেন সহকারি বার্তা নিয়ন্ত্রক টিপু? অভিযোগটি তদন্তের দাবি সচেতনমহলের।
অভিযোগে আরো জানা গেছে, দুই বছর আগে চাকুরী ছেড়ে দেওয়া সংবাদ সাপোর্ট শিল্পী মনোয়ারা আকতার মিনুর নামে প্রতিমাসে ২ হাজার টাকা সম্মানী উত্তোলন করেছেন এসিএন টিপু। সরকারি বাজেটের হিসাব না থাকায় বেতারে দুর্ণীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়েছে বলে জানান কর্মরতরা।
এদিকে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো উপজেলা সংবাদদাতাদের লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, প্রতিমাসে তাদের নামে জনপ্রতি ৭৫০০ টাকা থেকে ৮০০০ টাকা পর্যন্ত সম্মানী ভাতা উত্তোলন করেন সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক হেমায়েত আকবর টিপু। অথচ সম্মানী ভাতা তাদের দেয়া সর্বোচ্চ আড়াই হাজার টাকা। সম্মানী ভাতার বাকী টাকা টিপুর পকেটেই ঢুকছে বলে অভিযোগ।
কক্সবাজার বেতার কেন্দ্রে ৬ জন উপজেলা সংবাদদাতা রয়েছে। তাদের নামে প্রতিমাসে ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত সম্মানী ভাতা উত্তোলন করে যাচ্ছেন টিপু। তাছাড়া অনেক মাসের ভাতাও বন্ধ রেখে দেয়া হয় উপজেলা সংবাদদাতাদের।
অভিযোগ রয়েছে, সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক হেমায়েত আকবর টিপুর সাথে উর্ধ্বতন অফিসের এক সিনিয়র কর্মকর্তার সাথে ‘গভীর সখ্যতা’ রয়েছে। মাসিক মাসোহারা পাঠানো হয় তার কাছে। এ কারণে অনিয়ম-দূর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন।
অভিযোগ দায়ের করায় একজন উপজেলা সংবাদদাতাকে গডফাদারের মাধ্যমে ইতোমধ্যে চুক্তি বাতিল করে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। অভিযোগ করলে উপজেলা সংবাদদাতাদেরও চাকুরীচ্যুত করা হবে বলে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন এসিএন টিপু। তার ক্ষমতার দাপটে অনেকটা অসহায় কর্মরতরা।
ভুক্তভোগী বেতার সাংবাদিকগণ জানিয়েছেন, ন্যায্য পাওনা পরিশোধের জন্য আন্দোলন শুরু করলে দুর্নীতিবাজ টিপু বেতার সাংবাদিকদের ‘বেয়াদব’, ‘বদমায়েশের দল’, ‘অসভ্য’, ‘বেঈমান’ ইত্যাদি গালমন্দ করেছেন অনেকবার। বেতারের বার্তা বিভাগের একনিষ্ঠ কর্তব্যপরায়ন ও দায়িত্ববান কর্মচারী হিসেবে পরিচিত আবদুল আজিজকে টিপু বিভিন্ন কৌশলে চাকুরী ছাড়াতে বাধ্য করেছেন।
আজিজ অভিযোগ করেছে, দুর্নীতিবাজ টিপু তাকে চাকুরীচ্যুত করে তার নামে বেতন উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে তাকে সকাল ৮টা থেকে রাতের ৮টা পর্যন্ত অফিসে বসে থাকার নির্দেশ দেন। এতে রাজী না হওয়ায় আজিজকে গত বছর চাকুরী ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন। পরবর্তীতে আবদুল আজিজ চাকুরী ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি সদর দপ্তরে লিখিতভাবে জানালে দুর্নীতিবাজ টিপু তার উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। ক্ষিপ্ত টিপু কয়েক মাস আগে বিডিআর ক্যাম্পস্থ বাসায় পুলিশ পাঠায়। বার্তা নিয়ন্ত্রক টিপুর দুর্নীতির কোন তথ্য প্রকাশ না করার জন্য বাসার সবাইকে ধমক দিয়ে আসে পুলিশ। টিপু এখনো বার্তা বিভাগের কর্মচারীদের কথায় কথায় পুলিশের ধমক দেওয়া অব্যাহত রেখেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তসলিমা রহমান টুম্পা ও তাছলিমা বেগম নামে ২ জন্য অনিয়মিত শিল্পীর নামে প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা করে উত্তোলন করে তাদেরকে আড়াই হাজার টাকা করে ধরিয়ে দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। ৫০০ টাকা কম দেয়া হচ্ছে কেন? জানতে চাইলে ‘দুর্নীতির বরপুত্র টিপু’ তাদেরকে বকা ঝকা করেন এবং অভিজ্ঞতা হলে ৩ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে জানিয়ে দেন। যদিওবা পরবর্তীতে এই দুই নারী কর্মচারীকে ৩ হাজার টাকা করে দিতে বাধ্য হন।
ট্রেজারী বিলগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসিএন টিপু ভুয়া কর্মচারী ও বিল ভাউচার দেখিয়ে প্রতি মাসে ৪৫ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত অবৈধভাবে উত্তোলন করে যাচ্ছেন। আর এই অবৈধ বিল পাশে জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের একজন অডিটরও জড়িত বলে বিশ্বস্থ সূত্রে জানা গেছে।
পাঠক/পাঠিকারা অভিযোগ করেছে, যারা অডিশন দিয়ে পাশ করে তালিকাভুক্ত হয়েছেন তাদের বাদ দিয়ে অডিশনবিহীন পাঠক/পাঠিকাদের দিয়ে সংবাদ পাঠ করানো হচ্ছে। এর ফলে সিডিউল দিলেও তালিকাভুক্ত পাঠক/পাঠিকারা সংবাদপাঠে বেতারমুখী হন না। সংবাদ পাঠের জন্য যারা বেতারে আসতে পারবে না, তাদের নাম দিয়েই সিডিউল তৈরী করা হয়। প্রকৃত পাঠক/পাঠিকাদের বঞ্চিত করে মাসের অধিকাংশ সংবাদ টিপু নিজেই সংবাদ পড়ে থাকেন। কেউ কথা বললে তাকে সিডিউল দেওয়া হয় না। টিপুর স্বেচ্ছাচারিতার কারণে বর্তমানে ৮ জন অডিশনবিহীন পাঠক/পাঠিকা সংবাদ পাঠ করছেন।
গত ৫ বছরে এসিএন টিপু কত দিন খবর পড়ে কত টাকা পকেটে ঢুকিয়েছেন তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জাানিয়েছেন তালিকাভুক্ত পাঠক/পাঠিকাগণ।
সংবাদ পাঠকরা জানিয়েছেন, অনুবাদক পদে একজন ভুয়া সাংবাদিক ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ ওই ব্যক্তি জীবনে এখনো সংবাদ লিখার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন না। তাছাড়া কম্পিউটার অপারেটর নুরুল ইসলাম, হিসাব সহকারী তাহেরুল ইসলাম ও পরিচ্ছকর্মী শিল্পী মল্লিক নামে তিনজনের চাকরীর অনুমোদন নিয়ে এসেছেন। এই নামে কোন কর্মী কক্সবাজার বেতারে নেই। অথচ তাদের নামে বেতন ভাতাও উত্তোলন করা হচ্ছে।
সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক হেমায়েত আকবর টিপুর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমূহ তদন্তে তথ্য মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এর পৃথক কমিটি গঠনের দাবি ভুক্তভোগীদের। একই সাথে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগটিকে দুর্নামমুক্ত করতে সংশ্লিষ্টদের আরো সজাগ হওয়ার আবেদন করছেন কক্সবাজার বেতার কেন্দ্রে কর্মরতরা।
অবশ্যই এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক মো: হেমায়েত আকবর টিপু। তিনি বলেন, আমি যোগদানের আগে ৩ মাস পর্যন্ত কোন কর্মকর্তা ছিলনা। যোগদানের পর অফিস শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সাধ্য মতো চেষ্টা করি। অফিস ডিউটিতে কড়াকড়ি করেছি। এ সময় অফিসের নিয়ম-শৃঙ্খলা মানতে না পারায় একজন পদত্যাগ করে।
তিনি বলেন, যেসব বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছিল সেগুলো উপ-পরিচালক ছৈয়দ জাহির স্যার তদন্ত করেছেন। অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তবে, তদন্ত রিপোর্ট হাতে আছে কিনা জানতে চাইলে তার কাছে নেই বলে জানান।
পাঠকের মতামত: