কক্সবাজার প্রতিনিধি :: জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দীর্ঘ এক বছর ভর্তি ছিলেন নেজাম উদ্দিন। তার বাড়ি কক্সবাজার সদরের খরুলিয়া এলাকায়। তিনি কক্সবাজার কারকারি কলেজে চাকরি করতেন। প্রতিদিনের মতো মোটরসাইকেলে অফিসে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সামনে একটি গরু ও অন্যপাশে ট্রাকের ধাক্কা তার মোটরসাইকেলে এসে লাগে। এতে মোটরসাইকেল নিয়ে পাশের খাদে পড়ে যান তিনি। প্রাণে বেঁচে গেলেও চোখ ও চার হাত পা ভেঙ্গে হাসপাতালে কাটিয়েছেন এক বছর। তার দুই হাতের কব্জি ভাঙ্গা ভাল হলেও দু’চোখ এখনো অনিশ্চিত। দেখতে পায়না ঠিক মতো। নিজামের মা আজুমেহের বেগম বলেন, ‘গত এক বছরে প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে। বাড়িতে থাকা গরুসহ অন্যান্য জিনিসপত্র বিক্রি করেও চিকিৎসা করতে বিভিন্ন জনের মাধ্যমে দেড় লাখ টাকা লোন নিয়েছিলাম। পরিবারের উপার্জনক্ষম ছেলেটি সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হওয়ায় তারা এখন পথে বসার উপক্রম।’
জানা গেছে, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কটি এখন মৃত্যুপুরী। প্রতি বছর কমপক্ষে ৫’শ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারায় এই সড়কে। গত ৩ মাসে এই সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে এই সড়কে। হাজার হাজার পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে। এই নীরব হত্যাকাণ্ডের জন্য কাউকে খুব একটা কৈফিয়ত দিতে হয় না। নিতে হয় না দায়দায়িত্ব। সড়ক দুর্ঘটনার প্রভাব শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর ওপরই নয়, সমাজ জীবনেও পড়ছে। প্রতিবছর বিপুসংখ্যক মানুষের এই অপ্রত্যাশিত প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ববরণের প্রভাব পড়ছে বিভিন্নভাবে।
কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ১৬০ কিলোমিটার। এই সড়কের সিংহভাগ গেছে চকরিয়া উপজেলার উপর দিয়ে। প্রায় এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রতিনিয়ত এই সড়কে ঝরছে তাজা প্রাণ। সড়কটিতে মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। দিনের পর দিন দীর্ঘ হচ্ছে। খালি হচ্ছে হাজারো মায়ের বুক।সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে চকরিয়ার ডুলাহাজরা মালুমঘাট এলাকায় ১০ দিন আগে মারা যাওয়া পিতার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ ভাই নিহত হয়েছেন। আহতও হয়েছেন আরো তিনজন। সেদিন ৫ সন্তান হারিয়ে মায়ের মর্মস্পর্শী আর্তনাদ যেন সারা দেশের মানুষের অন্তর কেঁপেছে। এছাড়া রবিবার ৬ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১১টার দিকে চকরিয়া উপজেলার খুটাখালীর মেধাকচ্ছপিয়া এলাকায় বাস, ট্রাক ও পিকআপের ত্রিমুখী সংঘর্ষে ৩জন নিহত হয়েছেন। এ সময় আহত হয়েছেন প্রায় ১৫ জন।
গত ২৭ জানুয়ারি চকরিয়া উপজেলার হারবাং লালব্রিজ এলাকায় রাস্তা পার হতে গিয়ে যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় মো. মাহিয়ান (৭) নামের এক শিশু নিহত হন। ২৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০ টার দিকে রামু উপজেলার তেচ্ছিপুল এলাকায় মোটরসাইকেলযোগে বাড়ি ফেরার পথে বেপরোয়া গতির বাসচাপায় মো. হেলাল উদ্দিন (৩৫) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক মারা যান। ১৪ জানুয়ারি বিকেল ঈদগাঁও উপজেলার চান্দের ঘোনা এলাকায় যাত্রীবাহী পূর্বাণী বাসের চাপায় সিএনজি চালিত অটোরিকশার ২ যাত্রীসহ চালক প্রাণ হারান। এর রেশ কাটতে না কাটতে পরদিন ঈদাগাঁওতে জমির মাটিবাহী বেপরোয়া ডাম্পার ট্রাকের চাপায় মামুনুর রশিদ (২৪) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়।
১১ জানুয়ারি চকরিয়া ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ জন মারা গেছেন। চকরিয়ার আজিমনগর এলাকায় গাছের সঙ্গে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় মা ও ছেলের করুন মৃত্যু হয়। চকরিয়ার বেন্ডিবাজার এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেপরোয়া গতির একটি যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস পুকুরে পড়ে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান একই পরিবারের ছয়জন।
১২ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারার পাগলিরবিল এলাকায় পিকনিক বাস ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে বাস চালকসহ ২জন প্রাণ হারিয়েছেন। এই ঘটনায় আহত হন ১৫ জন। প্রায় প্রতিদিনই এ সড়কে কারো না কারো প্রাণ ঝরছে। ৮ জানুয়ারি দুপুর সাড়ে ১২ টার দিকে চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের নয়াপাড়া গেইট এলাকায় ফজলুল করিম প্রকাশ কালু (৮০) নামে এক বৃদ্ধ। ওইদিন চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় উপজেলার আধুনগর স্টেশনের দক্ষিণে আতিয়ারপুল এলাকায় একটি মালবাহী ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে গেলে চালক এবং তাঁর সহযোগী মৃত্যু হয় এ দুর্ঘটনায়।
সচেতন মহল বলছেন, মৃত্যু অনিবার্য। কেউ তা থামাতে পারবে না। তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন। একটি দুর্ঘটনা একটি পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয়। স্বজন হারানোর বেদনা সারা জীবন বইতে হয়। প্রিয়জন হারানোর কষ্টের কোনো বর্ণনা হয় না। যে হারায় কেবল সেই বোঝে।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্য মতে, চলতি বছরে চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া অংশে। সেখানে প্রায় প্রতিদিন গড়ে একটি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। তাদের কাছে সঠিক কোন তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত ৩ মাসে শতাধিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটনা ঘটেছে।
দুর্ঘটনা কবলিত এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ‘চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কটি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। সড়কটিকে প্রশস্ত না করলেও বেপরোয়া গতিতে চলছে যানবাহন। এছাড়া অনুমোদনবিহীন নছিমন, করিমন, ট্রলি, ইজিবাইকও চলছে দেদারছে। গাড়ির গতি বেশি থাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ঘটছে দুর্ঘটনা। আবার বেপরোয়া গতি, প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো, গাড়ি চালাতে চালাতে মোবাইল ফোনে কথা বলাসহ বহু অনিয়ম ঘটে এ রাস্তায়। এসব কারণে রাস্তায় মৃত্যুর মিছিল লেগেই আছে। যাদের এসব নিয়ন্ত্রণ করার কথা তারাও উদাসীন।’
তাদের মতে, বাস-ট্রাক চালকদের ডোপ টেস্ট করা প্রয়োজন এবং হাইস্পিডে যে গাড়িগুলো চলে গতি নির্ধারক মেশিন দিয়ে চেকিং করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। এ সড়কটিতে অনেক মোড়। কিছু মোড় আছে যা দূর থেকে বোঝা দায়। আক্ষেপ করে অনেকে বলছেন, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কটি যেন ক্রমশই মরদেহের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই আরেকটি রক্তের দাগ এসে আরও লাল করে দিচ্ছে সড়কগুলো। এ ঘটনায় জড়িত চালকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান তারা।
নিহতের স্বজনরা বলছেন, এ হায়েনার দল চালকেরা। এতো এতো আন্দোলন হয়। তারপরও এদের হুঁশ হয় না। দুর্ঘটনায় জড়িত চালকদের ফাঁসি দেওয়ার হলে সড়ক দুর্ঘটনা কমতো। সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে করণীয় সরকারের জানা। আগেও সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কিছু ব্যক্তির স্বার্থের কারণে এখন পর্যন্ত এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি বলেন, ‘করোনায় মৃত্যুর খবরের মধ্যে আরো একটি খবর আমাদের সবাইকে প্রতিনিয়ত ভাবিয়ে তুলছে। বিষয়টি সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিন বাড়ছে সড়কে মৃত্যুর সংখ্যা। বহু ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে রাস্তায়, যেগুলোর নিয়ন্ত্রণে সমস্যা রয়েছে। লাইসেন্সহীন অদক্ষ চালকের হাতে, এমন কী অপ্রাপ্তবয়স্ক চালকের হাতে গাড়ির চাবি তুলে দেওয়া হচ্ছে। মাদকাসক্ত চালকদের যানবাহন চালানো, লক্কড়-ঝক্কড় যানবাহন, ঢিলেঢালা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, আগে যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, নিয়ম না মেনে ওভারটেকিং, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো, পেছনের বাসকে সামনে আসতে না দেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে এ সড়কে। অনেক চালক রাত-দিন গাড়ি চালান। অত্যধিক ক্লান্তি ও গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার কারণেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটছে।’
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. ফারুক হোসেন সিকদার বলেন, ‘বেপরোয়া গাড়ি চালানোই সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে বার বার চিহ্নিত করা হয়েছে। চালকদের বড় অংশই যে অদক্ষ, অপ্রশিক্ষিত, লাইসেন্সবিহীন, প্রতিযোগিতাপ্রবণ এবং ট্রাফিক আইন তোয়াক্কা না করা, সেটা বার বার পর্যবেক্ষণ, সমীক্ষা ও গবেষণায় উঠে এসেছে।’
পাঠকের মতামত: