ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

এত মধু এমপিগিরিতে !

অনলাইন ডেস্ক ::

দেশ স্বাধীনের পর ব্যবসায়ী পেশার সংসদ সদস্য ছিলেন ১৫ শতাংশ। কয়েক দশকের ব্যবধানে তা বেড়ে ৬৯ শতাংশ হয়েছে। গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন এক হাজার ১০৭ জন। এবার বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ এবং আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ বিভিন্ন দল মিলিয়ে সংখ্যাটি প্রায় ১২ হাজার। এত বেশিসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়াকে অত্যধিক ও অস্বাভাবিক বলেই দেখছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। রাজনীতি বিশ্লেষক, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন, আইন প্রণেতা হিসেবে সংসদ সদস্যের নির্দিষ্ট কর্মপরিধি আছে। তবে এর বাইরেও বহু সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থাকায় সংসদ সদস্য হওয়ার দৌড়ে যোগ দিচ্ছেন হাজার হাজার মনোনয়নপ্রত্যাশী।

সুইজারল্যান্ডের বাংলাদেশ দূতাবাস ও সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশনের (এসডিসি) যৌথ প্রতিবেদন ‘দ্য রিয়েল পলিটিকস অব বাংলাদেশ : দি ইনসাইড স্টোরি অব লোকাল পাওয়ার ব্রোকারস’ প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। তা থেকে জানা যায়, দেশে ছয় বছরের কম সময়ে সংসদ সদস্যদের আয় বেড়েছে ৩২৪ শতাংশ। বর্তমানে সংসদ সদস্যদের বার্ষিক গড় আয় প্রায় কোটি টাকা, যা একজন সাধারণ মানুষের আয়ের প্রায় শতগুণ। ১২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সংসদ সদস্যদের আয় বৃদ্ধির তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় উল্লেখকৃত তথ্যের তুলনা করে এতে বলা হয়েছে, ২০০৮ সালে সংসদ সদস্যদের বার্ষিক গড় আয় ২৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা ছিল, ২০১৩ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৯৮ লাখ ৭১ হাজার টাকা। তবে এর বাইরে বেশির ভাগ সংসদ সদস্যের আয় আরো বেশি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), নির্বাচন কমিশন, সংসদ সচিবালয়, সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনায় একটি চিত্র স্পস্ট হয়ে উঠেছে। আর তা হচ্ছে ব্যবসায়ীদের কবজায় চলে গেছে দেশের রাজনীতি। তাদের কাছে ত্যাগী রাজনীতিকরা কোণঠাসা। যাদের হাতে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ আছে ও প্রভাব বিস্তার করতে পারছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে এখন মাঠের রাজনীতি। জাতীয় সংসদেও এর প্রতিফলন তীব্রতর হচ্ছে ক্রমেই।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘বাংলাদেশে সুশাসনের সমস্যা, উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, ৮১.৮ শতাংশ জনগণ বিশ্বাস করে, সংসদ সদস্যরা প্রশাসনিক কাজে প্রভাব বিস্তার করেন। ৭৬.৯ শতাংশ জনগণ মনে করে, সংসদ সদস্যরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করেন। উন্নয়ন বরাদ্দের অপব্যবহার, অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত হওয়া বা সমর্থন, সরকারি কেনাকাটায় প্রভাব বিস্তার, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্লট বরাদ্দ নেওয়ার সুযোগও নেন বেশির ভাগ সংসদ সদস্য।

দেখা গেছে, পাঁচ বছরে একেকটি সংসদীয় আসনে গড়ে হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ হয়। থাকে চাকরির জন্য সুপারিশ, রাস্তার উন্নয়নসহ বিভিন্ন কাজে আধাসরকারি পত্র বা ডিও লেটারে কাজ বাগিয়ে নেওয়ার পথ। অনেক ক্ষেত্রে উন্নয়নকাজে সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যদের বেশির ভাগ কোথাও ১০ শতাংশ, কোথাও তার চেয়ে বেশি কমিশন পান বলে প্রচার রয়েছে। সম্মানীর বাইরেও সরকারি ফ্ল্যাট, শুল্কমুক্ত গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণ, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে বৈধ-অবৈধ নানা আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আছে বেশির ভাগ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে।

সংসদ সচিবালয়, সুশাসনের জন্য নাগরিকসহ (সুজন) বিভিন্ন সংস্থার তথ্য পর্যালোচনায় জানা যায়, বাংলাদেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্যের মধ্যে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৫ শতাংশ, সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ী পেশার সংসদ সদস্য বেড়ে হন ৬৯ শতাংশ। ১৯৫৪ সালে তা ছিল ৪ শতাংশ। দশম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনসহ ব্যবসায়ী পেশার সংসদ সদস্য ২১৪ জন, আইনজীবী ৪৮ জন, রাজনীতিক ২২ জন। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) গবেষণা থেকে বের হয়েছে, দশম সংসদের ২২৬ জন বা ৬৫ শতাংশ সংসদ সদস্যের সম্পদ কোটি টাকার ওপরে। আওয়ামী লীগের ১৯৪ জন বা ৭১ শতাংশই কোটিপতি। জাতীয় পার্টির ১৮ জন বা ৪৫ শতাংশের সম্পদ কোটি টাকার বেশি। জাসদের ছয়জন ও ওয়ার্কার্স পার্টির একজন সংসদ সদস্য কোটিপতি। তরীকত ফেডারেশনের দুজনের দুজনই কোটিপতি। স্বতন্ত্র এমপিদের মধ্যে আটজন কোটিপতি।

এবার মনোনয়নপ্রত্যাশীদের বড় অংশই ব্যবসায়ী। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ৮০ শতাংশ ব্যবসায়ী। প্রবাসে চুটিয়ে ব্যবসা করেন এমন ব্যক্তিরাও দেশে এসে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে নেতিবাচক আভাস পেয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছেন মনোনয়ন পেতে। প্রবাসীবহুল সিলেট অঞ্চল থেকেই অর্ধশতাধিক কোটিপতি মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছেন।

বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ড. মোজাম্মেল হোসেন মাতব্বর বলেন, তিনি ২২ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। ২০১৪ সালেও মনোনয়ন চেয়েছিলেন, এবারও চেয়েছেন। তাঁর মতে, উচ্চাভিলাষ থেকে ব্যবসায়ীরা সংসদ সদস্য হতে চাইছেন, এটা দৃশ্যমান। তবে তিনি নিজে ব্যবসার পাশাপাশি মাঠের রাজনীতিতেও সক্রিয়।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারে টানা দুই মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসেছেন ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে। সম্প্রতি তিনি রাজনীতিতে লুটপাট হচ্ছে স্বীকার করে বলেছেন, এই লুটপাট আরো ১০ বছর পর্যন্ত থাকবে। দারিদ্র্য এর বড় কারণ।

গণফোরামে যোগ দিয়ে হবিগঞ্জ-১ আসনে ধানের শীষ নিয়ে লড়তে প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া। তিনি বলেন, রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আনার জন্য রাজনীতিতে নামছি। ব্যবসার জন্য রাজনীতি করা সমীচীন নয়।

মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অতি উৎসাহকে ‘উৎসব’ বলতে নারাজ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমদ। তিনি বলেন, এটা রাজনীতির নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির নির্দেশক। সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদ সদস্যের কর্মপরিধির বাইরেও আরো কিছু সুবিধা তাঁকে দেওয়া হচ্ছে। ফ্ল্যাট, প্লট পাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কাজে সুপারিশ করে কমিশন নেওয়ার বিষয়টি অজানা নয়। ব্যবসায়ীদের আধিক্য থাকায় জাতীয় সংসদে একটি বিশেষ গোষ্ঠীর প্রভাব বেশি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। জাতীয় সংসদে সব পেশার জনপ্রতিনিধির সম্মিলন ঘটলে তাতে আলাদা সৌন্দর্য থাকত। না হলে এটা হয়ে যাবে টাকা দিয়ে কেনা গণতন্ত্রের মতো।

গত ২২ নভেম্বর রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, রাজনীতি এখন দেশের বড় ব্যবসা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা আকবর আলি খান ‘অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, বর্তমানে সংসদ সদস্যদের অনুপার্জিত মুনাফা অর্জনে বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক মওকুফ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের আচরণ বৈষম্যমূলক এবং শুল্ক মওকুফের সুবিধা অনুপার্জিত মুনাফা অর্জনের সহায়ক।’ এসব বন্ধের দাবি জানিয়ে তিনি লিখেছেন, বর্তমান সংসদ সদস্যরা নির্বাহী বিভাগের অর্থে বিদেশ সফরের জন্য যে স্টাডি ট্যুরের ব্যবস্থা করেছেন, তাও অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্যের অনেকে সাধারণ জীবন যাপন করেন। এমনকি ভারতেও কোনো কোনো মন্ত্রী সাইকেল চালান। বিদেশে কোনো কোনো এমপির বাসা ভাড়া করার টাকাও থাকে না। যেমন—যুক্তরাষ্ট্রের সংসদ কংগ্রেসের সদ্য নির্বাচিত সদস্য আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কোর্তেজ ওয়াশিংটন ডিসিতে কোনো ধরনের অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিতে পারছেন না। কারণ তাঁর কাছে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেওয়ার মতো অর্থ নেই। আগামী জানুয়ারিতে নিজ দপ্তরের দায়িত্ব পাবেন তিনি। এর আগে তিনি কোনো বেতন-ভাতা পাবেন না। সম্প্রতি দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে এ অবস্থার কথা জানিয়েছেন ২৯ বছর বয়সী ডেমোক্রেটিক পার্টির এ নেত্রী। বাংলাদেশে সরল জীবনে বিশ্বাসী রাজনীতিকরা অবহেলিত। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্যাগের রাজনীতির পক্ষে। তিনি বারবার বলে থাকেন, রাজনীতি ভোগের জন্য নয়। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি গণভবনে যুবলীগের ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানেও বলেছেন, ভোগে নয়, ত্যাগেই সার্থকতা।

গত সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অংশ নেয় ১২টি। এবার ৩৯টি দলের মধ্যে বেশির ভাগই অংশ নেবে বলে মনে করা হচ্ছে। গত নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন এক হাজার ১০৭ জন। এবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে ১১ হাজার ২১টি। এর মধ্যে বিএনপির চার হাজার ৫৮০টি, আওয়ামী লীগের চার হাজার ২৩টি ও জাতীয় পার্টির দুই হাজার ৪১৮টি। বরগুনার একটি আসন থেকেই আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ৫২ জন, বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতিও উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এবার ছোট দলগুলোর মনোনয়নপত্র কম বিক্রি হয়েছে। যেমন বিকল্পধারার মনোনয়নপত্র শতাধিক, গণফোরামের মনোনয়নপত্র বিক্রি হয়েছে চার শতাধিক। এলডিপির মনোনয়ন পেতে মনোনয়নপত্র নিয়েছেন অর্ধশতাধিক, হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদের মনোনয়নপত্র নিয়েছেন আড়াই শর বেশি ব্যক্তি। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মনোনয়নপ্রত্যাশী শতাধিক। ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ইসলামী ফ্রন্টসহ ছোট দলগুলোর মনোনয়নপ্রত্যাশী সীমিত। কালের কন্ঠ

পাঠকের মতামত: