শামীমুল হক :: টার্গেট শিশু, কিশোর ও তরুণ। মূলত তাদের লক্ষ্য রেখেই দেশে দেশে উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস। উদ্ভাবনী কৌশল, সুগন্ধি ব্যবহার এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনের কারণে কিশোর এবং তরুণদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডব্লিউএইচও’র ২০২১ সালের তথ্য মতে, বাজারে ১৬,০০০ ধরনের স্বাদ ও গন্ধযুক্ত ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা সহ বেশকিছু দেশে এসব পণ্যের ব্যবহার ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। আমেরিকায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে সেখানে স্কুলপড়ুয়া তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহার ৭৮ ভাগ বেড়েছে। হাইস্কুলপড়ুয়া তরুণদের ৮৫ শতাংশই বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত ই-সিগারেট ব্যবহার করে। কারণ এসব স্বাদ বা গন্ধ তাদের পছন্দ।
ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস হলো ই-সিগারেট, ভ্যাপিং, হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট।
যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ভয়াবহতা বিবেচনা করে বিশ্বের অনেক দেশ এসব পণ্য বন্ধে ইতিমধ্যে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসের ব্যবহার ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। কিন্তু এগুলো নিয়ন্ত্রণ কিংবা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসের আবির্ভাবের পর থেকে বিশ্বব্যাপী তামাক ব্যবহারের পদ্ধতি ও ব্যবহার, বিপণন কৌশল, তামাক আসক্তি সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি এবং তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যু প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কৌশলী প্রচারণার কারণে এসব পণ্যের জনপ্রিয়তা এবং ব্যবহার বর্তমানে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
অতি সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রকাশিত WHO Report on Global Tobacco Epidemic ২০২১-এ ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেমস অর্থাৎ ই-সিগারেটসহ সকল ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টকে স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে যারা এসব পণ্যে আসক্ত তাদের মধ্যে সিগারেট শুরু করার সম্ভাবনা দ্বিগুণেরও বেশি। ইলেক্ট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি প্রোডাক্ট তামাকপণ্য ব্যবহারের গেটওয়ে হিসেবে কাজ করে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউএস সার্জন জেনারেল রিপোর্ট ২০১৬-এ ই-সিগারেটসহ নিকোটিনযুক্ত সকল পণ্যকে ‘অনিরাপদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
বিশেষ করে ২০১৯ সালে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং-সৃষ্ট শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যে মহামারি আকার ধারণ করলে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসগুলো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ফুসফুসজনিত রোগে ভর্তি হওয়া ২,৮০৭ জন রোগীর মধ্যে ৬৮ জনের মৃত্যুর সঙ্গে ই-সিগারেটের যোগসূত্র থাকার কথা নিশ্চিত করেছে।
ই-সিগারেট এবং ভ্যাপিংয়ের ধোঁয়ায় নিকোটিন এবং অন্যান্য বিষাক্ত কেমিক্যাল থাকে। যা মারাত্মক ক্ষতিকর। এগুলো ব্যবহারকারীর ফুসফুসের সংক্রমণ ও অসুস্থতা বাড়ায় এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়।
বাংলাদেশেও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসের ব্যবহার তরুণ এবং যুব সমাজের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। রাস্তাঘাট, ক্যাম্পাস, তরুণদের আড্ডাস্থল, বিভিন্ন মার্কেট এবং রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা ভ্যাপিং ক্লাবে এসব পণ্যের ব্যবহার ব্যাপকহারে চোখে পড়ছে। ঢাকা সহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বিক্রয়কেন্দ্র। অনলাইন এবং ফেসবুকে ব্যাপকভাবে ই-সিগারেট সামগ্রী নিয়ে আলোচনা, বিক্রয় ও হাতবদল হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৭ সালে পরিচালিত গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে অনুযায়ী বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে ই-সিগারেট ব্যবহারের হার ০.২ শতাংশ। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৯ শতাংশই তরুণ, যাদের বয়স ২৪ বছর বা তার নিচে। তামাক কোম্পানিগুলোও এই বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে যেকোনো উপায়ে তামাকপণ্য ও ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টে আসক্ত করে নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং মুনাফা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। এ জন্য তারা ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টসকে সিগারেটের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে ভোক্তা এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে উপস্থাপন করে থাকে।
বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট অর্থাৎ ই-সিগারেট সহ সকল ভ্যাপিং এবং হিটেড তামাকপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, বিক্রয় ও বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো। তাদের যুক্তি ই-সিগারেট এবং হিটেড টোব্যাকো প্রোডাক্ট বিক্রি নিষিদ্ধ করা হলে তরুণ এবং কিশোর বয়সিদের ধূমপানে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে। ভারত ইতিমধ্যে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এ ছাড়াও শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ ৩২টি দেশ এসব পণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে।
পাঠকের মতামত: