ঢাকা,শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

আতঙ্ক কাটছে শেয়ারবাজারে

sharebazar-special-newsঅনলাইন ডেস্ক :::

দরপতন ও লেনদেন খরার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার আভাস দিচ্ছে দেশের শেয়ারবাজার। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে লেনদেনের গতিও বেড়েছে যথেষ্ট। আড়াই মাস ধরে প্রতিদিন ৪০০ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে। এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠে এসেছে মূল্য সূচক।

বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০১০ সালের মহাধসের পর বাজারে যে সংকট দেখা দিয়েছিল তা আস্তে আস্তে কেটে উঠছে। ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাজার ইতিবাচক ধারায় ফেরার ইঙ্গিত দিতে থাকে। গত এক বছর ধরে বাজারে অস্বাভাবিক উত্থান অথবা বড় ধরনের পতন দেখা যায়নি।

এতে বাজারের ওপর প্রায় সব শ্রেণির বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসছে। অস্বাভাবিক উত্থান-পতন না থাকায় বিনিয়োগকারীদের লোকসান দিয়ে বাজার ছাড়তে হচ্ছে এমন খবর বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছে না। বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে নতুন করে বিনিয়োগে ফিরছেন ব্যক্তি বিনিয়োগকারীরা।

তাদের মতে, সম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক আমানত ও সরকারি সঞ্চয়পত্রের সুদহার ব্যাপক হারে কমেছে। এ কারণেও শেয়ারবাজারের প্রতি ব্যক্তি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বেড়েছে। আবার বিনিয়োগ সীমা নিয়ে ব্যাংক খাতে যে সমস্যা ছিল, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সহায়তায় তাও কেটে গেছে। ফলে ব্যাংক কোম্পানির শেয়ার বিক্রির চাপ বাড়ার যে ভিতি দেখা দিয়েছিল তাও কেটে যাচ্ছে।

গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে শেয়ারবাজার নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়সহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ইতিবাচক বক্তব্য দেন।

সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শেয়ারবাজার নিয়ে মন্তব্য করার পর থেকেই সূচক ও লেনদেনে গতি ফিরতে দেখা যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। সঞ্চয়পত্রের সুদ হার ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ দশমিক ২৬ শতাংশে নিয়ে আসা হয়।

এতে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে ঘুরপাক খাওয়া লেনদেন চলে আসে ১ হাজার কোটি টাকায়। ডিএসইর প্রধান সূচক পৌঁছে যায় ৪ হাজার ৮০০ পয়েন্টের ঘরে। তবে সূচক ও লেনদেনের ওই গতি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। গত বছরের শেষের দিকে বাজারে আবার কিছুটা নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়। লেনদেনের গতি কমে ৩০০ কোটি টাকায় চলে আসে। সূচকও কমতে কমতে ৪ হাজার ১০০ পয়েন্টের ঘরে নেমে যায়।

এরপর কয়েক দফা উত্থান-পতনের পর চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে বাজারে ইতিবচক প্রবণতা দেখা দেয়। ছোট ছোট উত্থানে সূচক ও লেনদেন উভয় ক্ষেত্রেই কিছুটা গতি ফিরে। গত ৪ মাস ধরেই বাজারে এ অবস্থা বিরাজ করছে। এ সময়ের মধ্যে বাজারে যেমন অস্বাভাবিক উত্থান ছিল না তেমনি ছিল না অস্বাভাবিক পতন।

ডিএসইর লেনদেন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০১০ সালে পর গত ছয় বছরে ১ হাজার ৩৬৮ দিন লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ডিএসইর প্রধান সূচক বেড়েছে ৬৫৯ দিন এবং কমেছে ৭০৯ দিন। তবে গত ২৬ কার্যদিবসের মধ্যে ২০ দিনই সূচক বেড়েছে। আর চলতি বছরের ১৮৯ কার্যদিবসে বেড়েছে ৯৮ দিন এবং কমেছে ৯১ দিন।

তবে লেনদেন ও সূচকে গতি ফিরলেও শেয়ারবাজারে সার্বিক সুশাসনে এখনো কিছুটা ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ‘১৯৯৬ এবং ২০১০ সালের শেয়ার কারসাজির হোতাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

সর্বশেষ কারসাজির ঘটনায় খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও পুনর্গঠিত নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওই কারসাজির হোতাদের খুঁজে পেতে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই নেয়নি। ফলে সুশাসন নিয়ে কিছুটা প্রশ্ন রয়েই গেছে। যদি কারসাজিকারীদের বিচারের করা সম্ভব হতো তাহলে মানুষের মধ্যে আস্থা আরও বাড়ত বলে মনে করছেন তারা।

প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ

বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ দিন নীরব থাকা কিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী আবার বাজারে সক্রিয় হয়েছেন। প্রতিদিন তারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শেয়ার লেনদেন করছেন। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে ডিএসইর মোট লেনদেনে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ ছিল ৫৩ শতাংশের মতো। ওই সময় ডিএসইতে গড় লেনদেন ছিল ৩০০ থেকে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা। আর শেষ তিন মাসে ডিএসইর মোট লেনদেন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের অংশ ৫৫ শতাংশের ওপরে উঠে এসেছে। এ সময়ে ডিএসইতে প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে।

বিদেশি বিনিয়োগ

চলতি বছরে শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শেয়ার লেনদেন এবং ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবধান উভয় বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশিদের বিক্রয়ের থেকে শেয়ার ক্রয় বেশি হয়েছে ৫৮৭ কোটি টাকা। যা আগের বছরে ছিল ৮১ কোটি টাকা।

এদিকে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশিরা ৬ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকার লেয়ার লেনদেন করেছে। এর মধ্যে শেয়ার ক্রয়ের পরিমাণ ৩ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। এর বিপরীতে বিক্রয় ছিল ২ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরে বিদেশিরা যে পরিমাণ শেয়ার বিক্রয় করেছেন তার থেকে ৫৮৭ কোটি টাকার শেয়ার বেশি ক্রয় করেছেন।

আগের বছরের প্রথম নয় মাসে বিদেশিদের মোট লেনদেন ছিল ৫ হাজার ৪৬৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্রয় ২ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা এবং বিক্রয় ২ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা। বিক্রয়ের থেকে ক্রয় বেশি ছিল ৮১ কোটি টাকা।

বাজার মূলধন

চলতি বছরের প্রথম কার্যদিবস ডিএসইর বাজার মূলধন ছিলো ৩ লাখ ১৫ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। জুলাইয়ের শুরুতে তা বেড়ে ৩ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। আর ১৬ অক্টোবর লেনদেন শেষে তা আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ১২ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। আর শেষ সাড়ে তিন মাসে বেড়েছে ৯ হাজার ৪১১ কোটি টাকা।

সূচক ও লেনদেন

বছরের শুরুতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল ৪ হাজার ৬২৪ পয়েন্টে। আর লেনদেন ছিল ৩৬৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। মে মাসের উত্থানের পর জুন মাসে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা দেওয়ায় সূচক ও লেনদেন উভয় কমে যায়। জুলাইয়ের শুরুতে ডিএসইএক্স সূচক কমে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪৯৫ পয়েন্টে এবং লেনদেন নেমে আসে ২০৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকায়। তবে এর পরেই ঘুরতে থাকে শেয়ারবাজার। ছোট ছোট উত্থানে ১৬ অক্টোবর শেষে ডিএসইএক্স ৪ হাজার ৭০৯ পয়েন্ট এবং লেনদেন ৪ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকায় চলে এসেছে।

ব্যাংকের শেয়ার

সার্বিক শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ালেও ৪টি ব্যাংকের শেয়ার অভিহিত মূল্যের নিচে রয়েছে। এ ছাড়া ডাচ-বাংলা ও ব্র্যাক ব্যাংক বাদে বাকি ব্যাংকগুলোর শেয়ার ৩০ টাকার মধ্যে লেনদেন হচ্ছে। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শেয়ার দাম ১০৭ টাকা এবং ব্র্যাংক ব্যাংকের শেয়ার ৬০ টাকার ওপরে লেনদেন হচ্ছে।

আতঙ্ক কাটছে বিনিয়োগকারীদের

বাজারে বর্তমানে বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ২৯ লাখ ১২ হাজার ৭৯৪টি। এর মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগকারী ২৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৩৯টি, প্রবাসীদের ১ লাখ ৪২ হাজার ৮৭টি এবং বিভিন্ন কোম্পানির ১০ হাজার ৭৬৮টি। গত দেড় মাসে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা প্রায় দেড় হাজারের ওপরে বেড়েছে। টানা দরপতনে আতঙ্কে থাকা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে গত কয়েক দিনের বাজার চিত্র কিছুটা স্বস্তি নিয়ে এসেছে। অনেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী নতুন করে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছেন।

বিশ্লেষকদের মন্তব্য

শেয়ারবাজার বিশ্লেষক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ২০১০ সালের ধসের পর বাজারে যে আস্থা সংকট দেখা দিয়েছিল, তা এখন নেই বলেই মনে হচ্ছে। বাজারে বেশ কিছুদিন ধরে অস্বাভাবিক উত্থান বা পতন দেখা যাচ্ছে না। এটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু শেয়ারবাজার নিয়ে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকে শেয়ারবাজারকে জুয়ার দান মনে করে। এ ভুল ধারণা ভাঙানো গেলে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে ব্যাপক বিনিয়োগ বাড়ানো সম্ভব। তবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ঝুঁকি রয়েছে, তাই বিনিয়োগের আগে অবশ্যই বিনিয়োগকারীদের ভালো করে তথ্য যাচাই-বাছাই করতে হবে।

বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, শেয়ারবাজার যে অবস্থায় নেমে ছিল সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোটাই স্বাভাবিক। বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি বলছে আস্থা বেড়েছে এবং যারা বিনিয়োগের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তারা বিনিয়োগ করছেন। তবে এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের অতিউৎসাহিত হয়ে বিনিয়োগ না করে সচেতনভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। অবশ্য আমার সন্দেহ হয় কোনো গ্রুপ ইচ্ছা করে শেয়ারবাজারে দরপতনের ঘটনা ঘটিয়ে ছিল কি না।

ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা ইতিবাচক ও স্বাভাবিক। মানি মার্কেটের চেয়ে শেয়ারবাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে। বাজারে বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। এখানে আস্থার ও ইমেজের কোনো সংকট নেই। এ ছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক ইতিবাচকতায় অবস্থায় রয়েছে। ফলে আশা করা যায় শেয়ারবাজার গতিশীল হবে।

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাইফুর রহমান মজুমদার বলেন, শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক উত্থান স্বাভাবিক পক্রিয়ারই অংশ। শেয়ারবাজারে উত্থান-পতন স্বাভাবিক নিয়ম। সেই ধারাবাহিকতায়ই এই উত্থান। শেয়ারবাজার স্টাবিলিটির সিগন্যাল (স্থিতিশীলতার আভাস) দিচ্ছে। দ্য রিপোর্ট

পাঠকের মতামত: