মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া :: পার্বত্য বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম উপজেলার আজিজ নগর ডলুছড়ি রেঞ্জ সহ ফাইতং এলাকার বিভিন্ন প্রকারের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে দেদারসে চলছে গাছ-কাঠ লুটের মহোৎসব। গণিমতের মালের মতো সরকারী সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কেটে সাবাড় করে আসলেও এ নিয়ে কোন ধরনের মাথা ব্যথা নেই খোদ বন বিভাগের!
পার্বত্য লামার উপজেলার আজিজ নগর কেন্দ্রীক কিছু সংঘবদ্ধ চিহ্নিত গাছ চোর চক্র ও পেকুয়া বাজার কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির কিছু অসাধু নেতার সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে বনাঞ্চলের গাছ-কাঠ পাচার হলেও বন বিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন রহস্যজনক কারণে কোন ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছেনা।
বারবাকিয়া রেঞ্জ অফিস মাঝেমধ্যে কিছু লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করলেও বেশিরভাগ চোরাই গাছ-কাঠবাহী পিকআপ-ট্রাক আটক করেনা। কিছু আটক করলেও মোটা অংকে ম্যানেজ হয়ে ছেড়ে দেয়। রাতদিন সমানতালে লামা-আজিজনগর-আলীকদমের বিভিন্ন সরকারী বনাঞ্চল থেকে আজিজ নগর কেন্দ্রীক সংঘবদ্ধ গাছ ও কাঠ পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা গাছ-কাঠ কেটে তা পিকআপ-ট্রাক বোঝাই করে বরইতলী-পেকুয়া সড়কের উপর দিয়ে পেকুয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অবস্থিত অবৈধ সমিলে ও কাঠের দোকানে পাঠানো হ্েচ্ছ। বরইতলী-পেকুয়া সড়কের মধ্যবর্তী পয়েন্টে বারবাকিয়া রেঞ্জ এর অধীনে পহরচাঁদা বনবিট কার্যালয় থাকলেও সেখানকার বনবিট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লামা-আজিজ নগর-আলীকদম থেকে চোরাই পথে আসা কোন পিকআপ-ট্রাক আটক করেনা।
এভাবে গাছ-কাঠ পাচারের ঘৃণ্যযজ্ঞ আগামী কয়েক বছর চলতে থাকলে লামা-আলীকদম ও চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় হওয়ার আশংকা রয়েছে। আর সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় হলে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা করছেন স্থানীয় পরিবেশবাদী সচেতন বাসিন্দারা।
প্রাপ্ত অভিযোগের ভিত্তিতে জানা গেছে, চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের অধীন পেকুয়া উপজেলায় অবস্থিত বারবাকিয়া বন রেঞ্জ অফিসে কর্মরত রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক ও বনবিট কর্মকর্তা আমির হোসেন গজনবীকে ম্যানেজ করে পেকুয়া-বরইতলী সড়ক দিয়ে চলাচলকারী চোরাই কাঠ বোঝাই ট্রাক-পিক আপ থেকে বেপারোয়া চাঁদাবাজি শুরু করেছে পেকুয়া বাজার কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি নামের একটি সংগঠন! প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা চাঁদার টাকা উত্তোলনের জন্য মাসিক বেতনে নেজাম উদ্দিন নামের একজনকে ক্যাশিয়ার পদেও নিয়োগ করেছে ওই কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি। পেকুয়ার ক্যাশিয়ার নেজাম পেকুয়া চৌমুহুনী ও পেকুয়া বাজারে অবস্থান করে প্রতিনিয়তই চাঁদার টাকা উত্তোলন করছে। উত্তোলিত চাঁদার টাকা থেকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের অধীন পেকুয়া উপজেলার বারবাকিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক ও বিট কর্মকর্তা আমির হোসেন গজনবীকে নির্ধারিত হারে মাসিক বখরার টাকা দেওয়া হচ্ছে। আর প্রতিটি গর্জন গাছবোঝাই গাড়ি থেকে ৩ হাজার টাকা করেও অতিরিক্ত চাঁদার টাকা নিচ্ছেন রেঞ্জ কর্মকর্তা। প্রতি মাসে চাঁদার টাকার ভাগ পেয়ে নিরব রয়েছে রেঞ্জ কর্মকর্তা হাবিবুল হক ও বিট কর্মকর্তা আমির হোসেন গজনবী। আর এ সুযোগে পেকুয়া-বরইতলী সড়ক দিয়ে প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত লামা, আলীকদম, চকরিয়া ও আজিজ নগরের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ সাবাড় করে পেকুয়ার বিভিন্ন অবৈধ সমিল ও কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছে আজিজ নগর কেন্দ্রীক অসাধু কাঠ পাচারকারী সিন্ডিকেট।
লামার আজিজ নগর কেন্দ্রীক অবৈধ কাঠ পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যদের সাথে পেকুয়া বাজার কেন্দ্রীক কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির লোকজনের সাথে রয়েছে গভীর সখ্যতা। এছাড়া পেকুয়া বাজার কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি পেকুয়া থানার সদ্য বদলী হওয়া ওসির নাম ভাঙ্গিয়েও অবৈধ কাঠ পাচারকারী পিকআপ-ট্রাক থেকেও নিয়মিত চাঁদার টাকা উত্তোলন করছেন। পেকুয়া বাজার কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির একাধিক সদস্যের কাছ থেকে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চকরিয়া, লামা, আলীকদম ও আজিজ নগরের বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে প্রতিনিয়তই দিনেরাতে রাতে সমানতালে পাচার হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-কাঠ! সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে শুরু করে সামাজিক বনায়নও রেহাই পাচ্ছে না আজিজ নগর কেন্দ্রীক কাঠ পাচারকারীদের থাবা থেকে। বন ধ্বংসকারী গাছ-কাঠ পাচারকারীদের সঙ্গে যোগসাজেশ রয়েছে স্থানীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। পেকুয়া-বরইতলী সড়ক দিয়ে প্রতিবছর সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলে বনের গাছ-কাঠ পাচারের মহোৎসব। উক্ত ৮মাস পেকুয়া বাজার কাঠ ব্যবসায়ী সমিতি ও বনকর্মীদের কাছে দুহাতে টাকা কামানোর ‘গুড সিজন মৌসুম’ নামেও বেশ পরিচিত!
জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ফান্ডসহ সরকারী অর্থায়নে সৃজিত বন-বাগান ধ্বংসের পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছে সরকারের সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি। চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের পেকুয়া উপজেলার ১টি রেঞ্জ অফিসের আওতায় ৩টি বন বিটের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকেও চলছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-কাঠ পাচারের মহোৎসব। এছাড়াও লামার আজিজ নগর এলাকার বিভিন্ন সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে পাচার হওয়া এসব কাঠ-গাছ পেকুয়া উপজেলার বিভিন্ন হাটে-বাজারে স্থাপিত অবৈধ করাতকলে নিয়ে স্তুপ করে রাখা হচ্ছে। পাচার হওয়া গাছ-কাঠগুলোর মধ্যে রয়েছে আকাশমণি, জারুল, জাম, গামারি, কড়ই ও গর্জনসহ নানা প্রজাতির গাছ। আজিজ নগরের সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে কাঠ পাচারকারীরা দিনে এসব গাছ কেটে রাতভর তা পেকুয়ার বিভিন্ন সড়ক দিয়ে আশেপাশের বিভিন্ন সমিলে পাচার করা হয়। রাত যত গভীর হয় ততই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে বনের গাছ-কাঠ পাচার।
টইটং ইউনিয়নের ধনিয়াকাটা গ্রামের বাসিন্দা জহির উদ্দিন অভিযোগ করেছেন, ধনিয়াকাটা ও টইটং বাজার সড়ক দিয়ে প্রতিনিয়তই সরকারী বনাঞ্চলের গাছ পাচার হয়। বন বিভাগকে গাছ পাচার রোধে ব্যবস্থা নিতে বললেও তারা কথা শুনেনা।
বারবাকিয়ার বাসিন্দা মাহমুদুল করিম অভিযোগ করে জানান, বারবাকিয়ার রেঞ্জ কর্মকর্তা কর্মকর্তা হাবিবুল হক ও বিট কর্মকর্তা আমির হোসেন গজনবীর কারণেই বনাঞ্চল নিধনের পাশাপাশি জবর দখলও হচ্ছে। তিনি রেঞ্জারের অপসারণ করতে উর্দ্ধতন বন বিভাগের হস্থক্ষেপ কামনা করেছেন।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে বারবাকিয়া রেঞ্জ অফিসের বনবিট কর্মকর্তা আমির হোসেন গজনবীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিনি বারবাকিয়া বনবিটে যোগদান করার পর থেকে তার অর্পিত সরকারী দায়িত্ব পালন করছেন। বরইতলী-পেকুয়া সড়ক দিয়ে গাছ-কাঠ পাচারের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে চোরাই কাঠবাহী গাড়ি অভিযান পরিচালনা করে আটক করা হলে তা ছাড়িয়ে নিতে তদবীর করে পেকুয়া বাজার কাঠ ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা। তাই বাধ্য হয়েই ছেড়ে দিতে হয়।
পাঠকের মতামত: