ঢাকা,শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪

আওয়ামী লীগের তৃণমূলে ক্ষোভ, রদবদল আসছে প্রার্থী তালিকায়!

অনলাইন ডেস্ক ::   দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সারা দেশে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়ায় সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডে বাছাই করা কিছু আসনের প্রার্থী শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলটির প্রার্থী তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশের পর নেতাকর্মীরা ছুটে আসে ঢাকায়। গত মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার তারা গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের ক্ষোভের কথা জানায়। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।

সূত্র আরো জানায়, গণভবনে দলের সভাপতির সঙ্গে দেখা করে নেতাকর্মীরা বলেছে, জনবিচ্ছিন্ন এমপিদের মনোনয়ন দেওয়া হলে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। প্রার্থীদের পরাজয়ের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ক্ষমতা ধরে রাখার ব্যাপারে সংশয় ব্যক্ত করে নেতাকর্মীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু আসনে সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে আশ্বস্ত করেন শেখ হাসিনা। আগামীকাল রবিবার দলটির চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের কথা রয়েছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘মনোনয়নবঞ্চিতদের বক্তব্য আমরা শুনেছি। তাদের দেওয়া তথ্য বিবেচনা করা হবে।’ তিনি জানান, আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। সবাইকে মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব হয় না। যারা যোগ্য অথচ মনোনয়ন পায়নি তাদেরও মূল্যায়ন করা হবে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বলেন, যাঁরা মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন বলে দাবি করছেন, নেত্রী তাঁদের কথা শুনেছেন। তিনি সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের প্রধান, তাঁদের (বঞ্চিতদের) মনোনয়ন দেবেন কি দেবেন না—সেটা সম্পূর্ণ নেত্রীর এখতিয়ার।

বুধবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন যুব মহিলা লীগের সহশিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও পাঠাগার সম্পাদক সরকার ফারহানা আক্তার সুমি। তিনি নীলফামারী-১ আসনে দলের প্রার্থিতার বিষয়ে শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘নেত্রী, আমি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, এই আসনে যদি খালেদা জিয়াও এসে আমার সঙ্গে নির্বাচন করেন তাহলে তাঁর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।’ বর্তমান এমপি আফতাব উদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতার অভিযোগ এনে সুমি বলেন, তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হলে নৌকার ভরাডুবি হবে।’

বৈঠক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের বলেন, দেখো দেখো, তাঁর কনফিডেন্স কী রকম?

এ সময় হাততালি দেন শেখ হাসিনা। আবেগাপ্লুত শেখ হাসিনা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে সুমির নাম নোট করে রাখার জন্য বলেন।

সরকার ফারহানা আক্তার সুমি গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘আমার এলাকার জনগণ আমার জন্য কাঁদছে। এখান থেকে আমি সরে যাব কেন?’ সুমি জানান, তাঁর মনে হয়েছে নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কিছু আসনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে পারেন।

বরগুনা-১ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী মশিউর রহমান শিহাবসহ জেলার আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা বুধবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন। শিহাব দলের সভাপতিকে বলেন, ‘সাধারণ জনগণ আমাকে চায়। আমি জুনিয়র হলেও জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে শীর্ষে আছি। নেত্রী, বরগুনার সাধারণ মানুষকে বাঁচান। বর্তমান এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে নিয়ে মাঠে নামলে পাবলিক আমাদের জুতো দিয়ে পেটাবে। তাঁকে এলাকায় অবাঞ্ছিত করা হয়েছে।’

জবাবে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি বরগুনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিইনি। তুমি আলোচনায় আছ।’ শেখ হাসিনা বৈঠকে উপস্থিত বরগুনার দলীয় নেতাকর্মীদের কাছ থেকে একজনের নাম চান বলে বৈঠক সূত্র নিশ্চিত করেছে।

জানতে চাইলে মশিউর রহমান শিহাব বলেছেন, তাঁরা আশাবাদী বরগুনা-১ আসনে প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত হওয়া ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুকে বাদ দিয়ে তাঁদের মনোনীত প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। তাঁরা স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ৭২ জন নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ জাহাঙ্গীর কবিরের নাম দলের সভাপতির কাছে জমা দিয়েছেন বলে জানান।

কুমিল্লা-৩ আসনের বর্তমান এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুন। আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড প্রাথমিকভাবে মনোনয়নের জন্য তাঁর নাম চূড়ান্ত করেছে। গত বুধবার গণভবনে গিয়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম সরকার। তিনি এমপি ইউসুফ আবদুল্লাহ হারুনের বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দলের সভাপতিকে অবহিত করেন। জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, স্থানীয় এই এমপি গত পাঁচ বছরে এলাকার দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ৮৮টি মামলা দিয়েছেন। তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হলে সংগঠনের অনেক ক্ষতি হবে।

জাহাঙ্গীর আলম সরকার বলেন, তাঁদের দেওয়া তথ্য দলের সভাপতি শেখ হাসিনা নোট করে নিয়েছেন এবং অভিযোগের বিষয়গুলো মনোযোগ সহকারে শুনেছেন। তিনি আশাবাদী। চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন ঘোষণা হলে নেত্রী তাঁর ব্যাপারে বিবেচনা করবেন।

ঝালকাঠি-১ আসনের বর্তমান এমপি বি এইচ হারুন। তাঁকে মনোনয়ন দিলে আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হবে, এ কথা বলেছেন কাঁঠালিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তরুণ শিকদার। তিনিসহ কাঁঠালিয়া ও রাজাপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা গত বুধবার গণভবনে গিয়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় স্থানীয় এমপি বি এইচ হারুনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে কথা বলেন তাঁরা। শেখ হাসিনাকে ওই নেতা বলেন, এখানে ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মনিরুজ্জামান মনিরকে মনোনয়ন দেওয়া হলে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়ী হবে। এর বাইরে জয়ী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান মনির বলেন, নেতাকর্মীরা দেখা করে এলাকার অবস্থা অবহিত করেছে। নেত্রী মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনে নেতাদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখা হবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব.) এ বি তাজুল ইসলামকে। বিষয়টি জানতে পেরে গত বৃহস্পতিবার রাতে গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ মহি। তিনি ওই আসনে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করে দোয়া চান।

সূত্র মতে, জবাবে দলের সভাপতি বলেন, যাও, তোমার জন্য দোয়া রইল।

মহিউদ্দিন আহমেদ মহি বলেন, অন্যদের মতো তিনিও গণভবনে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে নির্বাচন করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। মহি জানান, যাঁরা মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন বলে মনে করছেন, তাঁরা নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁদের ক্ষোভের কথা বলেছেন। বঞ্চিতরা মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবি জানিয়েছেন।

চাঁপাইনাবগঞ্জ-২ (নাচোল, গোমস্তাপুর ও ভোলাহাট) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী আনোয়ারুল ইসলাম আনোয়ার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য। গত বৃহস্পতিবার গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন সাবেক এই ছাত্রলীগ নেতা। আনোয়ার এই আসনে দলের মনোনয়ন চেয়েছেন।

জানতে চাইলে আনোয়ারুল ইসলাম আনোয়ার বলেন, আমি নেত্রীর সঙ্গে দেখা করে দোয়া চেয়েছি। আমি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি। নেত্রী বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলে মনে করি।

সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের বর্তমান এমপি গাজী ম ম আমজাদ হোসেন মিলন। এ আসনে দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী সাইদুল ইসলাম খান পল। তিনি গত বৃহস্পতিবার গণভবনে গিয়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে মনোনয়ন চান। পল দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকা ও দলে তাঁর ভূমিকার বিষয়ে সভাপতিকে অবহিত করেন।

জানতে চাইলে সাইদুল ইসলাম খান পল গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, আমি নেত্রীর সামনে বক্তব্য রেখেছি। আশা করি, বঙ্গবন্ধুকন্যা আমার ব্যাপারে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন।

সূত্র জানায়, এভাবে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কয়েক শ নেতাকর্মী গত মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার দলীয় সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের ক্ষোভ-অভিযোগের কথা জানায়। তাদের সবার অভিযোগ ও বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন শেখ হাসিনা। কাউকে কাউকে ইতিবাচক সিদ্ধান্তের বিষয়ে আশ্বস্তও করেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।

পাঠকের মতামত: