ঢাকা,বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

অর্থনীতি গতিশীল হলেও পুঁজিবাজার গতিহীন

বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ গতিশীল। কিন্তু পুঁজিবাজারে কোনো গতি নেই। নানা সমস্যার কারণে পুঁজিবাজার বড় হচ্ছে না। এখানে ভালো শেয়ারের অভাব রয়েছে। অভাব রয়েছে অভিজ্ঞও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীর। বাজারের আচরণও বিনিয়োগবান্ধব নয়। ফলে লেনদেন আশানুরূপ হচ্ছে না। বর্তমান পুঁজিবাজার নিয়ে শেয়ার বিজের সঙ্গে কথা বলেন চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক ও আইল্যান্ড সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, এফসিএমএ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক সাইফুল আলম

শেয়ার বিজ: বর্তমান পুঁজিবাজারকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, এফসিএমএ: রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাজার প্রভাবিত হয় বলে অনেকের ধারণা। তবে এ ধারণা অমূলক নয়। আমি মনে করি, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও বাজারবান্ধব। গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নির্বাচনের পর বাজার গতিশীল হবে। নির্বাচন যদি কোনো কারণে বিতর্কিত হয় বা অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে, তাহলে বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

শেয়ার বিজ: কোনো কোম্পানি পরিশোধিত মূলধন কমালে পরবর্তী অর্থবছরে বোনাস দিয়ে মূলধন বাড়ানো কি যুক্তিসংগত?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন: এখানে দেখার বিষয়, কী কারণে নিকট অতীতে পরিশোধ মূলধন কমানো হয়েছিল। যদি অস্বাভাবিক লোকসান হয়ে থাকে এবং ভবিষ্যতে এ লোকসান কমানো অসম্ভব প্রতীমান হয়, তখন এ ধরনের লোকসান ব্যালেন্স শিট থেকে বাদ দেওয়ার জন্য পরিশোধিত মূলধন কমানো হয়। সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালে প্রকৃত মুনাফা হলে বোনাস দিয়ে মূলধন বাড়ানো যেতে পারে। আর যদি এত বেশি পরিশোধিত মূলধনের প্রয়োজন নেই বলে মূলধন কমানো হয়, সেক্ষেত্রে বোনাস দিয়ে পরবর্তীকালে পরিশোধিত মূলধন বাড়ানো অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক ও দুরভিসন্ধিমূলক। সাধারণত ডেভেলপড ইকোনমিতে ম্যাচিউর্ড সেক্টরের কোম্পানিতে অতিরিক্ত পরিশোধিত মূলধন কমিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের নগদ টাকা ফেরত দেওয়া হয়।

শেয়ার বিজ: কোনো কোম্পানি রাইট শেয়ার ইস্যু করলে পরবর্তী বছর ওই কোম্পানির ইপিএসে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন: রাইট শেয়ার ইস্যুর অর্থ হলো নগদ টাকা কোম্পানির হাতে আসা। রাইট শেয়ারের অর্থ কোথায় ব্যবহার হচ্ছে সেটাই দেখার বিষয়। রাইট শেয়ারের অর্থ দিয়ে যদি উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয় বা সেবা সম্প্রসারণ করা হয়, তাহলে বিক্রি বাড়বে এবং লাভও বাড়বে। আর যদি রাইটের টাকা দিয়ে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করা হয়, তাহলে ইন্টারেস্ট ব্যয় কমবে। অর্থাৎ রাইটের সম্পূর্ণ টাকা ব্যবহারের ফলে যদি উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ে বা খরচ কমে, তাহলে ইপিএসের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। আর যদি রাইটের টাকা অলস পড়ে থাকে বা আংশিক ব্যবহার হয়, তাহলে ইপিএস কমে যেতে পারে। আবার কোনো কোম্পানি রাইটের টাকা হাতে পাওয়ার পর সিংহভাগ দিয়ে কারখানা ভবন তৈরি বা যন্ত্রপাতি আমদানির প্রক্রিয়া হাতে নেয়, সেসব ক্ষেত্রে রাইট-পরবর্তী বছর উৎপাদন ও বিক্রি আগের মতো থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ রাইটের টাকা ব্যবহারের সুফল বিলম্বিত হবে এবং ইপিএস সমান থাকতে পারে বা ক্ষেত্রবিশেষে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

শেয়ার বিজ: স্পট মার্কেটে শেয়ার লেনদেনে কী কী বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন: সাধারণত এজিএম-সংক্রান্ত স্পট হলে কোম্পানি কী ধরনের লভ্যাংশ দিয়েছে অর্থাৎ কত শতাংশ নগদ বা বোনাস বা উভয়ের হার দেখতে হয়। বাজারের গতি-প্রকৃতি দেখতে হবে। সামগ্রিক বাজারের ইনডেক্স ঊর্ধ্বমুখী, না নিম্নমুখী এবং ওই খাতের সূচক বাজার সমান্তরাল, না বিপরীতমুখী? নিম্নমুখী বাজারে স্পটের সময় বিক্রি করা লাভজনক। ঊর্ধ্বমুখী বাজারে স্পটের সময় বিক্রি না করে রেকর্ড ডেটের পর বিক্রি করলে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

শেয়ার বিজ: অনেক কোম্পানি লভ্যাংশ দেয় না; এদের ব্যাপারে স্টক এক্সচেঞ্জ বা বিএসইসির করণীয় কী?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন: এটি একটি জটিল প্রশ্ন। কোনো অস্বাভাবিক কারণে কোনো বছর কোনো কোম্পানির উৎপাদন বা বিক্রয় বিঘ্নিত হলে কোম্পানি নো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারে। এরকম ক্ষেত্রে কোম্পানি ‘নো ডিভিডেন্ড’ দেওয়ার কারণ বা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দিলে স্টক এক্সচেঞ্জের উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা নয়। তবে ‘নো ডিভিডেন্ড’ তিন বছর ধরে চললে অবশ্যই স্টক এক্সচেঞ্জের তদন্ত করা উচিত। ওই কোম্পানিগুলোর দুরবস্থা থেকে উত্তরণের পরিকল্পনা জানতে চাইতে পারে। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নো ডিভিডেন্ড ঘোষণায় হ্যাটট্রিক করা কোম্পানির সংখ্যা ১৯ এবং আরও পাঁচটির হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা আছে।

শেয়ার বিজ: জুলাই-জুন আর্থিক বছর করার কারণে একই দিনে ৫০-৬০টি কোম্পানির স্পট লেনদেন হয়েছে। এ কারণে বাজারে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন: স্পটে লেনদেন করতে হলে নগদ টাকার প্রয়োজন। অন্যদিকে শেয়ার সরবরাহ বাড়ে। তাত্ত্বিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়: এ সময় বাজারে অর্থ সরবরাহ কমে যাবে। এর ফলে লেনদেনও কমে যাবে। অন্যদিকে যারা ট্রেড টার্মিনাল বা ট্রেড অপারেট করে, তারা এ পরিস্থিতি সামাল দিতে বা ট্রেড করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। সব কোম্পানির জুলাই-জুন আর্থিক বছর বাজারবান্ধব নয়।

শেয়ার বিজ: প্রায় অধিকাংশ মিউচুয়াল ফান্ডের দর এনএভির নিচে। বাজারে তেমন লেনদেন হয় না। এ অবস্থার কারণ কি হতে পারে?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন: আমরা যদি আইসিবি ফার্স্ট থেকে আইসিবি এইট মিউচুয়াল ফান্ডের ইতিবৃত্ত পর্যালো?না করি, তাহলে দেখতে পাব মিউচুয়াল ফান্ডের স্বর্ণযুগের চিত্র এখন আর নেই। সেই স্বর্ণযুগের সমাপ্তি হয়ে গেছে। বিভিন্ন মার্চেন্ট ব্যাংকের ৩৬টি মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড বাজারে আছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ফান্ড ম্যানেজারদের অদক্ষতা এজন্য দায়ী। প্রায় প্রত্যেকেরই একাধিক মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ড আছে। মিউচুয়াল ফান্ডের অবস্থা যা-ই হোক না কেন, ইস্যু ম্যানেজার প্রত্যেক ফান্ডের সম্পদের ওপর দুই থেকে দুই দশমিক ৫০ শতাংশ পরিচালনা কমিশন পেয়ে থাকে। মার্চেন্ট ব্যাংক, ট্রাস্টি, বিএসইসি প্রত্যেকে ফান্ড থেকে কমিশন বা ফি পেয়ে থাকে। এর সঙ্গে ফান্ডের পরফরম্যান্সের কোনো যোগসূত্র নেই। ফান্ড এক শতাংশ লভ্যাংশ দিলে কমিশন একই হারে পায় এবং ১০ শতাংশ দিলেও কমিশনের হারে কোনো পরিবর্তন হয় না। প্রকৃতপক্ষে মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের নগদ লভ্যাংশ দেওয়ারই কথা। নগদ লভ্যাংশ দিতে হলে ব্যবস্থাপনায় অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা লুকানোর কোনো পথ থাকে না। সর্বশেষ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডকে বে-মেয়াদি করার সুযোগ দিয়ে মিউচুয়াল ফান্ডের বাজারকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীদের মনে মিউচুয়াল ফান্ডের ওপর অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ডে ক্যাপিটাল গেইন প্রত্যাশার সমাধি হয়েছে।

শেয়ার বিজ: বিনিয়োগকারীরা অভিযোগ করেন তারা আর্থিক প্রতিবেদন সময়মতো পান না। এর কারণ কী?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন: বিনিয়োগকারীদের হাতে আর্থিক প্রতিবেদন বার্ষিক সাধারণ সভার আগে পৌঁছে দেওয়ার সংস্কৃতি আমাদের দেশে গড়ে ওঠেনি। বেশিরভাগ কোম্পানি তাদের আর্থিক প্রতিবেদন ইংরেজি ভাষায় দিয়ে থাকে। এ ধরনের প্রতিবেদন বিনিয়োগকারীরা পেলেও বুঝতে পারেন না। বার্ষিক প্রতিবেদন বিলিবণ্টন ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। এর মধ্যে নতুন সংযোজন হলো বিএসইসি আইন করে আর্থিক প্রতিবেদন পাঠানোর বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়েছে। এখনকার নিয়ম হলো বিনিয়োগকারীর ই-মেইলে পাঠাতে হবে। কোনো বিনিয়োগকারী লিখিতভাবে প্রিন্ট কপির জন্য আবেদন করলে কোম্পানির রেজিস্ট্রার্ড অফিস থেকে নিজ খরচে সংগ্রহ করতে হবে। বলা যায়, এ পদক্ষেপটি বিনিয়োগবান্ধব নয় এবং সময়োপযোগীও হয়নি। আরও পাঁচ-সাত বছর প্রিন্টেড আর্থিক প্রতিবেদন পাঠানোর বাধ্যবাধকতা রাখা উচিত।

শেয়ার বিজ: আমাদের দেশে এতগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকের কি প্রয়োজন আছে?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন: আমাদের এই ছোট দেশে, ছোট অর্থনীতিতে এবং ডিজিটাল যুগে এতগুলো বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। ৫৫টি বাণিজ্যিক ব্যাংক থাকার পর আরও তিনটির অনুমোদন অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক ফল আনবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় সেনাবাহিনী, বিডিআর ও পুলিশকে ব্যাংক দেওয়া হয়েছে। শোনা যায়, কর্মসংস্থান ব্যাংককেও বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কাজ করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। ব্যাংক না বাড়িয়ে ব্রাঞ্চ বা বুথ বাড়ানোর কথা ভাবা যেতে পারে। অনলাইন ব্যাংকিংয়ে ব্যাংক পরিচালনা ব্যয়বহুল। ডিজিটাল যুগে ছোট ব্যাংক লাভজনক হবে না। সম্ভব হলে মার্জারে যাওয়া উচিত। দুটোর বেশি ব্যাংক সরকারি খাতে থাকার প্রয়োজন নেই। এক কথায় দীর্ঘমেয়াদি সুষ্ঠু ব্যবস্থায় ব্যাংক খাতে সংস্কার ও সময়োপযোগী পরিচালনার জন্য নীতিমালা প্রয়োজন।

শেয়ার বিজ: আইপিওর টাকা ব্যবহারের আগে প্রথম বছর বোনাস শেয়ার ইস্যু করে মূলধন বাড়ানো কতটা যৌক্তিক?

মোহাম্মদ মহিউদ্দিন: সাধারণত অর্থের জোগানের জন্যই আইপিওতে আসা হয়েছিল। তৎপরবর্তীকালে নগদ অর্থের সংকট প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্লেষণে দেখা যায়, আইপিও-পূর্ব পারফরম্যান্স ভালো দেখানোর জন্য নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে এনএভি ইপিএস বাড়িয়ে দেখানো হয়। এর ফলে আইপিওর পরবর্তী বছরে পারফরম্যান্সে চাপ সৃষ্টি হয়।
বাজারের স্বার্থে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আইপিও-পরবর্তী স্টক ডিভিডেন্ড নিরুৎসাহিত করা প্রয়োজন অথবা উদ্যোক্তা পরিচালকদের বোনাস শেয়ারগুলো দুবছর পর্যন্ত লক-ইন করে রাখার নিয়ম করা যেতে পারে যেতে পারে।

পাঠকের মতামত: