‘এক্সকিউজ মি! আপনার নাম কি ডা. রিয়াদ’ অপরিচিত এক ব্যক্তির এমন প্রশ্নে রিয়াদের জবাব, ‘হ্যাঁ আমি ডা. রিয়াদ নাসের চৌধুরী।’ রিয়াদের এমন হ্যাঁ সূচক জবাব পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাশ থেকে আরও দুই ব্যক্তি সামনে এসে দাঁড়ায়। তিন ব্যক্তি রিয়াদের হাত চেপে ধরেই বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।’ রিয়াদের মনে তখন অজানা আশঙ্কা। তিনি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছিলেন না। মুহূর্তেই আরও কয়েকজন উপস্থিত। চারদিক ঘিরে ফেলেছেন তারা। রিয়াদকে ধাক্কিয়ে সামনের দিকে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এবার রিয়াদের সঙ্গে থাকা তার কলিগ ডা. সালেক অপরিচিত ব্যক্তিদের পরিচয় জানতে চান। তাদের সাফ জবাব, ‘আমরা প্রশাসনের লোক’। এ কথা বলেই রিয়াদকে ধরে তারা একটি মাইক্রোবাসে তুলে নেন। এর পরই লাপাত্তা। ২৯ সেপ্টেম্বর মিরপুর পূরবী সিনেমা হলের সামনের জনবহুল একটি রাস্তা থেকে ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয়ে এভাবেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ডা. রিয়াদকে। তার খোঁজ মেলেনি এখনো।
২৪ সেপ্টেম্বর রাত ৯টা। মতিঝিল থানার অদূরেই ওয়ান্ডার্স ক্লাব। সেই পথ ধরেই সবুজবাগের বাসায় ফিরছিলেন প্রিন্টিং ব্যবসায়ী বাবু চৌধুরী। হঠাৎ একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে থামে তার সামনে। নেমে আসেন তিন ব্যক্তি। তারা নিজেদের পুলিশ প্রশাসনের লোক বলে পরিচয় দিয়ে বাবু চৌধুরীর মোবাইল ফোনটি দেখতে চান। এর পরই তাকে বল প্রয়োগ করে তুলে নেন মাইক্রোবাসে। এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি এই ব্যবসায়ীকে।
‘পুলিশ’ আর ‘প্রশাসন’ পরিচয়ে এমন অপহরণের ঘটনা রাজধানীসহ সারা দেশেই আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। চিকিৎসক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, ছাত্র, বিভিন্ন পেশা-শ্রেণির মানুষ অপহরণের শিকার হচ্ছেন। কেউ ফিরছেন, কেউ ফিরছেন না। দিনে-রাতে রাস্তা থেকে, এমনকি হাজারো মানুষের মাঝখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। পুলিশ-প্রশাসন পরিচয় দেওয়ায় সাধারণ মানুষও এগিয়ে আসে না। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে নিখোঁজ হওয়ার আতঙ্ক বাড়ছে দিন দিন। অনেক ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তরাও নিচ্ছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের সুযোগ।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, পুলিশ পরিচয়ে অপহরণ করে নিয়ে গেলেও স্বজনদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কোনো সহযোগিতা করছে না।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, গত তিন বছরে ২১০ জনকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ করা হয়, যাদের মধ্যে শতাধিক ব্যক্তির হদিস মেলেনি। পুলিশের হিসাবে বছরে ১ হাজারেরও কম মানুষ অপহূত হয় এবং বেশির ভাগ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছে। তবে মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এ সংখ্যা আরও বেশি। অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, আলোচিত অপহরণের ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন হচ্ছে না। পাশাপাশি ‘প্রশাসনের লোক’ পরিচয়ে অপহরণের সঙ্গে কারা জড়িত তাও বের হয় না। এসব কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে নিখোঁজ আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত করে রহস্য বের করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন মানবাধিকারকর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা।
তবে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, অন্যান্য অপরাধের মতো অপহরণও নিয়ন্ত্রণে আছে। অপহরণকারীদের গ্রেফতার এবং অপহূতকে উদ্ধারের ঘটনাই বেশি বলে দাবি তাদের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এমন অনেক পলাতক ব্যক্তিকে অপহূত বলে দাবি করা হচ্ছে।
পুলিশ সদর দফতর থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৩ সালে সারা দেশে অপহরণ মামলা ছিল ৮৭৯টি, ২০১৪ সালে ছিল ৯২০টি। আর ২০১৫ ছিল ৮০২টি। অন্যদিকে, চলতি বছরের ৯ মাসে এ সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে।
অপহূত ডা. রিয়াদের ছোট ভাই ফাহাদ নাসের চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, তার ভাইকে অপহরণের পর তারা র্যাব, পুলিশ, ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব শাখায় যোগাযোগ করেন। পল্লবী থানায় মামলাও দায়ের করা হয়। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো সহযোগিতা করা হচ্ছে না। তার ভাইয়ের খোঁজ পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে তারা সংশয়ে। পরিবারের সবাই এখন আতঙ্কে রয়েছেন। তিনি বলেন, আগেও তার ভাইকে অপহরণের চেষ্টা করা হয়। পুলিশকে এ বিষয়টিও জানানো হয়েছে। কিন্তু উদ্ধারে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যে সাদা মাইক্রোবাসে করে তুলে নেওয়া হয়, সেই নম্বরের গাড়ি পাওয়া যায় ঘিওর থানায়। কিন্তু নম্বর এক হলেও গাড়ি ভিন্ন। ঘিওর থানায় থাকা একই নম্বরের মাইক্রোবাসটি পুলিশ নিজেই ব্যবহার করছে। ফাহাদ অভিযোগ করে বলেন, অপহরণকারীরা তাদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। অপহরণের ঘটনাটি সিসিটিভিতে স্পষ্ট দেখা গেলেও তারা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না।
প্রিন্টিং ব্যবসায়ী বাবু চৌধুরীকে না পেয়ে তার পরিবারের সদস্যরা এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন। পুলিশ ও র্যাবের কাছে জানানোর পরও বাবু চৌধুরীর কোনো খবর পাচ্ছেন না তারা।
রামপুরা থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন তপুকে অপহরণের অভিযোগ করেন তার মা সালেহা বেগম। তিনি বলেন, ২৬ জানুয়ারি ডিবি পুলিশ পরিচয়ে রাজধানীর ভাটারা থেকে অপহরণ করা হয় তপুকে। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। থানা পুলিশ বা ডিবি তাকে আটকের বিষয়টি স্বীকার করেনি। তবে পুলিশ বলছে, তপুর বিরুদ্ধে সিআইডির এএসপি ফজলুর রহমান হত্যা মামলাসহ এক ডজনের বেশি মামলা আছে। তাকে খুঁজছে পুলিশ।
এদিকে ৩ অক্টোবর গভীর রাতে ধামরাইয়ের ঢুলিভিটা এলাকায় ‘স্নোটেক্স’ নামক পোশাক কারখানার এক কর্মকর্তাকে ‘ডিবি পুলিশ’ পরিচয়ে অপহরণের সময় চার অপহরণকারীকে আটক করে পুলিশ। তারা হলেন ময়মনসিংহের ভৈলর চরপাড়া গ্রামের ইসমাইল হোসেনের ছেলে রাশেদ কবির (২৮), সাভারের জালেশ্বর এলাকার জুমাত আলীর ছেলে কয়েদ (৪৯), সাভারের উত্তর চাপাইন লালটেক এলাকার আবু হানিফের ছেলে মামুন (২৪) ও জালাল উদ্দিনের ছেলে সিরাজ (২৫)।
জানা গেছে, গভীর রাতে ওই পোশাক কারখানার জুনিয়র এক্সিকিউটিভ (স্টোর) আসাদুজ্জামান অফিস ছুটি হওয়ার পর হেঁটে ‘কচ্মচ্’ বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হন। এ সময় একটি প্রাইভেট কার থেকে নেমে চারজন লোক ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে তাকে গাড়িতে তুলে নেন। গাড়িতে ওঠানোর পর তাকে বলে, ‘তুই সন্ত্রাসী’। এরপর তাকে বাড়িতে ফোন দিয়ে টাকা আনতে বলে অপহরণকারীরা। এ সময় তার সঙ্গে থাকা নগদ সাড়ে ৩ হাজার টাকা ও একটি মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় তারা। গাড়িটি নান্নার এলাকায় গেলে আসাদুজ্জামান সেখানে ‘প্রস্রাবের কথা বলে’ প্রাইভেট কার থেকে নেমে দৌড়ে লোকালয়ে চলে গিয়ে স্থানীয়দের কাছে ঘটনাটি খুলে বলেন। পরে ওই প্রাইভেট কারটি (ঢাকা-মেট্রো-গ-১২-৮১০৩) ধাওয়া দিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সূতিপাড়া বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চারজনকে আটক করে জনতা। পরে তাদের গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দেওয়া হয়।
১২ আগস্ট ধামরাইয়ে ডিবি পুলিশের পোশাক পরে দুর্বৃত্তরা এক ব্যবসায়ীকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে অপহরণ করে ৩ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয়। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী আশুলিয়ার ডেন্ডাবর এলাকার মঞ্জুরুল ইসলাম জানান, তিনি দোকান থেকে দেড় লাখ ও আশুলিয়ার পল্লী বিদ্যুৎ বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক থেকে দেড় লাখ টাকা উত্তোলন করে চাল কেনার জন্য বাসে করে ধামরাইয়ের ঢুলিভিটায় নামেন। পরে পৌরসভার সীমা সিনেমা হলের কাছে একটি চালের মিলে যাওয়ার জন্য একটি অটোবাইকে ওঠেন। এ সময় পেছন থেকে আসা একটি কালো রঙের মাইক্রোবাস (হাইয়েস) অটোবাইকটির সামনে গিয়ে ব্যারিকেড দেয়। পরে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ওই ব্যবসায়ীকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে হাত-মুখ বেঁধে তার সঙ্গে থাকা ৩ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে রাতে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের আশুলিয়ার বেলতলা নামক এলাকায় ফেলে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশ প্রতিদিন
পাঠকের মতামত: