ঢাকা,বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

অনুগল্প : ‘অসহায়ত্ব’

cn:::: শহিদ রাসেল ::::

কামাল ছোটবেলা থেকেই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মধ্যদিয়ে আজ এই পর্যায়ে। দেখতে সত্তর বয়সের মনে হলেও সবে পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে। হাঁটতে হয় খুব ধীরে, লাঠি বা নাতিকে অবলম্বন করে। অথচ একটি সময়ে কামাল হাত-পায়ে চতুর্দিক সামলিয়েছে। পড়াশুনা বাল্যশিক্ষা পর্যন্ত হলেও সন্তানদের পড়াশুনায় কোনো ফাঁকিবাজি হতে দেয়নি। পরপর চারমেয়ে সন্তানের পর তিনটি ছেলের জন্মদিয়ে সবার ভরণ-পোষণসহ শিক্ষার সুব্যবস্থায় এতোটুকু কার্পণ্য ছিলনা তার। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে সমাজে সন্তানদের একটা সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিতে সদা সচেষ্ট ছিল কামাল।

খাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনীহার কারণে ক্ষীণ শরীরেও সংসারের হাল ধরতে অবিচল কামাল রাত-দিন পরিশ্রম করে আজ চুপসে যাওয়া জীবনের মানসাঙ্ক কষছে। নিজের জন্য আলাদা করে কিছুই না করার ফলে অসহায়ত্বের অভিশাপে বিপর্যস্ত কামাল এখন কেবল নির্বাক দিনাতিপাত করছে। নিজের আবেগ দিয়ে জীবন পারাপারে কামাল ছিটকে পড়েছে সমাজের একেবারে প্রান্তিক কাতারে। চারমেয়ের ধুমধাম করে বিয়ে দিয়েছে সে। বড় ও মেঝছেলেকে বিয়ে করানোর পর বাকি আছে কেবল ছোটছেলে। কর্মমূল্যায়নে বর্তমানে কামালের ‘রাজার হালে’ থাকার কথা থাকলেও নিতান্ত করুণ জীবনটাই বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এখন সিগারেট খাওয়ার পয়সাটাও ছেলে বা অন্যের কাছ থেকে আসে। অথচ একসময় সে রাগের বশে টাকার বা-েল ছিড়ে ছিন্নভিন্ন করেছে। প্রচন্ড রাগী কামাল কখনো কারো দ্বারে ধর্ণা দিতো না। আপোষহীনতা কামালের জেদ না স˜গুণ তা বুঝা মুশকিল। সবকিছুই নিজেই পরিচালনা এবং সন্তান ও আত্মীয়স্বজনসহ প্রতিবেশিদের সাহায্য-সহযোগিতায় দিলখোলা বিশাল মনের মানুষ কামালের এখন যেনো কিছুই নেই। গায়ের জোর শেষ হওয়ার পর সমাজ থেকেও ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকা কামালের সেই দাপুটে স্বভাব আর অবশিষ্ট নেই। কেবল মৃত্যুর প্রহরগুনে সময় পার করছে অর্ধমৃত কামাল। তার জীবনের একটাই বরং স্বস্তি হলো স্ত্রীর নিখার সেবা-যতœ ও ভক্তি। তারা পরস্পরকে এক মুহূর্তের জন্য আলাদা করেনা। যেনো জীবনসঙ্গির অনন্য দৃষ্টান্ত।

উপরোক্ত জীবনের গল্পটি কপালভাগ্যে ভিন্নদিকেও মোড় নিতে পারতো। সন্তানদের আদর-খেদমতে একটি সুন্দরতম অবসরে হাসিখুশি জীবন হতে পারতো কামালের। তার জীবনসঙ্গিও রাতদিন সরসারের জন্য খাটছে আর একটি সুখের ভবিষ্যত জীবনের আশায় বসতভিটার সবক’টি কাজের হাল ধরছে। এই দম্পতির কারো প্রতি কোনো অভিযোগ না থাকলেও ধীরে ধীরে জীবনের প্রতি এক তাদের তীব্র অভিমান জমাট বাঁধছে। দু’জনই যেনো পরস্পরকে সান্ত¦না দিয়েই জীবিত আছে কেবল। দু’জনেরই শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ বাসা বেঁধেছে।

এই গল্পটিকে বাস্তবতার নিরীখে আলোচনা করলে বেশ কয়েকটি অসঙ্গতি ধরা পড়ে। প্রথমত সন্তানদেরকে শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার পরেও কামালের দাম্পত্য জীবনের সুখের দেখা নেই। বস্তুত: সঞ্চয়ের মনোভাব না থাকার ফলেই তাদের এই শোচনীয় অবস্থা। পেশায় ড্রাইভার কামালের আয় খুব একটা ভালো ছিলো, সবক’টি সন্তানকে শিক্ষার অধিকারসহ সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে সর্বস্ব হারিয়েছে কিন্তু নিজের ভবিষ্যতের জন্য যদি কামাল প্রতি দিন বা সপ্তাহে কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক টাকা সঞ্চয় করতো, তবে জীবনের এই শেষ বয়সে এসে তাদেরকে অসহায়ত্বের নির্মমতা সহ্য করতে হতোনা। জীবনের পারিপার্শ্বিক বাস্তবতায় অনেককিছুই মানিয়ে চলতে হয়। আচরণের পরিবর্তন, পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলা, সুন্দর ও ভালো মনের মানুষে অনুসরণ-অনুকরণের দরকার আছে। সমাজে হাজারো আত্মীয়-প্রতিবেশির ভিড় থাকলেও বিপদের সময় পাশে কাউকেই যেনো পাওয়া যায়না। ঠিক ওই মুহূর্তেই নিজের সম্বল বা খুঁটি হিসেবে সঞ্চয় করা অর্থ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। হোক তা সামান্য বা বেশি। আর নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও কর্তব্যজ্ঞানে বাস্তবতার পরশ সুখী জীবনের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত।

সমাজের নি¤œ বা মধ্যবিত্ত মা-বাবার মানসিকতায় আবেগ জিনিসটা এতো বেশি যে, তারা অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত দেউলিয়া ঘোষিত হয়। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নিজের জন্য ভাবতে হবে। আমিত্ব’কে ভুলভাবে না নিয়ে শুদ্ধতার রূপ দিতে হবে। আমি যদি সবদিক থেকে ফিট থাকতে পারি, তবে আমার বাড়ি, গাড়ি, সমাজ বা সবকিছুর দেখভাল তথা নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় রাখতে পারবো। নি:স্বার্থ মানে এট হওয়া উচিত নয় যে, আমার যা আছে সবকিছু উজাড় করে পরের তরে বিলিয়ে দিতে হবে, হোক তা সন্তান বা নিকটাত্মীয়ের বেলায়। প্রথমেই নিজস্বতা সম্পর্কে একটি পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি জীবনের নিশ্চয়তা দরকার।

চলমান জীবনের ধারাপাতে আমাদেরকে অনেক নিষ্ঠুরতম পরিস্থিতির মোকাবেল করতে হয়। ওই সময়টাতে ‘আমার’ বলতে কিছুই যদি অবশিষ্ট না থাকে তবে আমাদেরকে লজ্জা ও অপমানের ধাক্কায় ‘ব্যক্তিত্বহীন’ বনে যেতে হবে। যা মোটেই মনুষ্যত্বের সাথে ঠিক যায়না। তাই আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে প্রত্যেককেই সচেতন হতে হবে। সব ধরনের পরিস্থিতির জন্য পূর্বপ্রস্তুতি রাখতে হবে। জীবনের ‘যাচ্ছে চলে যাক না’ ধারা থেকে বেরিয়ে আসার সময় নিত্য বয়ে যায়। সময় গেলে সাধন হবে না…

লেখক : কবি ও সাংবাদিক ।।

৬ তলা, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ভবন, জামাল খান, চট্টগ্রাম।।

০১৮৩৫৫৫৮৭১২

পাঠকের মতামত: