ঢাকা,বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

অনিয়মে নিমজ্জিত পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স!

মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া :: নানা অনিয়ম-দূর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার একমাত্র সরকারী স্বাস্থ্য সেবাদানকারি প্রতিষ্টান ‘পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’! সরকারী এ প্রতিষ্টানে কর্মরত গুটিকয়েক চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সীমাহীন অনিয়ম-দূর্নীতির কারনে স্বাস্থ্য সেবা মুখ থুবড়ে পড়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নানান অনিয়ম-দূর্নীতির বাসা বাঁধলেও উর্দ্ধতন স্বাস্থ্য বিভাগ ও কক্সবাজার জেলার সিভিল সার্জন কার্যকরী কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এখনকার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আরো বেপরেয়া হয়ে দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। সরকারী অফিস সময়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অধিকাংশ চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রায় সময় অনুপস্থিত থাকেন। আবার অনেকেই দুপুরের পরে অফিসে আসেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এক্সরে মেশিন থাকলেও টেকনেশিয়ানের অভাবে এক্সরে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা।

অপরদিকে গত ২২ বছর ধরে এক চিকিৎসকসহ ৫কর্মচারী এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত থাকার সুবাধে তারা সরকারী এ প্রতিষ্টানকে এক প্রকার জিম্মি করে নানান ধরনের অনিয়ম-দূর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। এছাড়াও প্রতিনিয়তই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কুকের দায়িত্বে থাকা নেজাম উদ্দিন হাসপাতালের ক্যান্টিনকে খাবার হোটেল বানিয়ে বানিজ্য চালিয়ে গেলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করছেনা।

প্রাপ্ত অভিযোগে জানা গেছে, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইচও ডা: ছাবের আহমদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে হাসপাতালের অফিস সহকারী নেজাম উদ্দিন হাসপাতালের বিভিন্ন বরাদ্দ আত্মসাৎ করেছে। নেজাম উদ্দিন গত ২২ বছর ধরে হাসপাতালের অফিস সহকারী পদে কর্মরত রয়েছে! তার বাড়ি পেকুয়া সদর ইউনিয়নে। নিজ উপজেলায় গত ২২ বছর ধরে সরকারী চাকুরীর সুবাধে এ কর্মচারী এখন কারো ধার ধারেনা। নিজের ইচ্ছেমতো হাসপাতালকে অনিয়ম-দূর্নীতির আঁখড়ায় রূপান্তরে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

এছাড়াও হাসপাতালের আরএমও ডা: মুজিবুর রহমানও গত ২২ বছর ধরে এই হাসপাতালে কর্মরত রয়েছে। আরএমও পদে কর্মরত থাকলেও এ চিকিৎসক পেকুয়া সরকারী হাসপাতালের আরএএমওর আবাসিক কোয়ার্টারে বসবাস করেনা। পেকুয়া বাজারের পূর্বে পাশের্^ আল নুর হাসপাতাল নামের একটি প্রাইভেট হাসপাতাল খুলে সেখানে অধিকাংশ সময় প্রাইভেটভাবে ভিজিট নিয়ে রোগী দেখেন। এ হাসপাতালটি নিজের স্ত্রীর নামে স্বাস্থ্য অদিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিয়ে পরিচালনা করছেন ঢা: মুজিবুর রহমান।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরএমও ডা: মুজিবুর রহমান জানান, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আগের তুলনায় ভাল সেবা দিচ্ছে। তিনি দায়িত্ব পালনে কোন সময়ে গাফিলতি করেনি।

জানা যায়, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিচ্ছনতাকর্মী মো: ইউনুচ, নিরাপত্তা প্রহরী জসিম উদ্দিন, অফিস সহায়ক ইসমাইল পালা করে হাসপাতালের নিচ তলায় অবস্থিত জরুরী বিভাগে আগত রোগীদের ড্রেসিংসহ চিকিৎসকের ভূমিকায় অবর্তীর্ণ হয়! হাসপাতালে কর্মরত উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডা: জিয়া উদ্দিনও প্রায় সময় হাসপাতালের দায়িত্ব ফাঁকি দিয়ে পেকুয়া চৌমুহুনীর একটি চেম্বারে ভিজিট নিয়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন। হাসপাতালের প্রত্যয়ন পত্র নেওয়ার সময় ডা: জিয়া উদ্দিনের নির্দের্শে জরুরী বিভাগের দায়িত্বরত কর্মচারীরা প্রতি কপি প্রত্যায়ন পত্রের বিপরীতে রোগীদের কাছ থেকে ১শত টাকা হারে আদায় করেন। গত ৮/১০ বছর ধরে প্রত্যয়ন পত্রের বিপরীতে লাখ লাখ টাকা আদায় করে সরকারী ফান্ডে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন ডা: জিয়া উদ্দিনের নেতৃত্বে হাসপাতাল কেন্দ্রীক একটি অসাধু সিন্ডিকেট চক্র।

প্রত্যায়ন পত্রের প্রদানের সময় রোগীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে ডা: জিয়া উদ্দিন জানান, প্রত্যায়ন পত্র বাবদ যে টাকা আদায় করা হয়, তা হাসপাতালের মসজিদের ইমামের বেতন প্রদান করা হয়। প্রত্যায়ন পত্র বিক্রি করে রোগীর টাকা নিয়ে কেন মসজিদের ইমামের বেতন দেওয়া হয় তার কারণ জানতে চাইলে তিনি কোন ধরনের সদুত্তর দিতে পারেনি।

পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের টিএইচও ডা: ছাবের আহমদের ভাইপু ডা: তাহমিদ সরকারী অফিস সময়ে চৌমুহুনী ষ্টেশনে ‘পেকুয়া চৌমুহুনী প্যাথলজি’ নামের একটি চেম্বারে ভিজিট নিয়ে রোগী দেখেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফার্মাসিষ্ট এর পদ শুন্য রয়েছে। এই সুবাধে হাসপাতালের এক অফিস সহায়ক ফার্মাসিস্টের দায়িত্ব পালন করছেন। কয়েকজন রোগী অভিযোগ করেছেন, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ফার্মাসিস্টের দায়িত্বে থাকা ওই অফিস সহায়ক প্রতিনিয়তই রোগীদের ঔষধ প্রদানের সময় চরম দূর্ব্যবহার করনে। এছাড়াও সরকারী হাসপাতালের দামি দামি ঔষধও চুরি করে নিয়ে যায়।

হাসপাতালের রোগীদের খাবার সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারের বিরুদ্ধেও রয়েছে অভিযোগ। হাসপাতালে প্রতিদিন যে পরিমাণে রোগী ভর্তি থাকে তার অতিরিক্ত রোগী দেখিয়ে রেজিষ্টারে লিপিবদ্ধ করেন ডায়েটের দায়িত্বে থাকা হাসপাতালের নার্স। হাসপাতালের অফিস সহকারী নেজাম উদ্দিনের সাথে আঁতাত করে ঠিকাদার নিম্নমানের খাবার সরবরাহ করে গত ৭/৮ বছর ধরে সরকারী টাকা লুটপাটে মেতে উঠলেও উর্দ্ধতন স্বাস্থ্য বিভাগ রহস্যজনক কারণে কোন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

পেকুয়া উপজেলার কয়েকটি কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বরত সিএইচসিপিরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যে কোন বিল উত্তোলনের সময় হাসপাতালের অফিস সহকারী নেজাম উদ্দিনকে বিলের উপর হিসাব করে ১০% হারে ঘুষ দিতে হয়। এমনকি বেতন-ভাতা উত্তোলনের সময়ও নেজাম উদ্দিনকে ঘুষ দিতে হয়। তার দাবিকৃত ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানালে কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপিদের নানানভাবে হয়রানী করা হয়। তাই অনেকটা বাধ্য হয়েই তারা নেজাম উদ্দিনের হাতে ঘুষের টাকা তুলে দিয়ে নিরবেই অনিয়ম সহ্য করে যাচ্ছেন।

‘আমরা পেকুয়াবাসী’ সংগঠনের যুগ্ম মহাসচিব মাও.জহিরুল ইসলাম জানান, হাসপাতালের দূর্নীতিবাজ টিএইচও ডা: ছাবের ও অফিস সহকারী নেজাম উদ্দিন একটি ডিজিটাল নেমপ্লেটের দাম ২৮ হাজার টাকা দেখিয়ে সরকারী টাকা লোপাট করেছেন। ওই ডিজিটাল নেমপ্লেটের দাম সর্বোচ্চ ২-৩ হাজার টাকা হবে। গত ১০ বছর ধরে হাসপাতালের জেনারেটরের জ¦ালানি খরচ বাবদ ভূঁয়া হিসাব দেখিয়ে টাকা উত্তোলন, হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতা বাবদ খরচ দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎসহ এমন কোন দূর্নীতি ও আত্মসাতের ঘটনা নেই যা অফিস সহকারী নেজাম উদ্দিন করেনি!

অভিযোগের ব্যাপারে জানতে পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও অফিস সহকারী নেজাম উদ্দিনের সাথে কথা হলে তিনি জানান, হাসপাতালে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত রয়েছেন সেটা ঠিক। তবে তিনি সততার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন কমিউিনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপিদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার প্রসংগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসম মিথ্যাচার। তিনি কারো কাছ থেকে ঘুষ নেননি।

পেকুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য জননেতা আলহাজ¦ আবুল কাসেম অভিযোগ করেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে একটি ডিজিটাল সাইন পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লাগানো হয়েছিল। কিন্তু, বিধিবাম সেখানে বঙ্গবন্ধু, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং চকরিয়া-পেকুয়ার সংসদ সদস্য আলহাজ¦ জাফর আলমের নাম আছে বলেই ওই হাসপাতালে কর্মরত জামায়াতপন্থী টিএইচও ডা: ছাবের আহমদ ও অফিস সহকারী নেজাম উদ্দিন গংরা মিলে ডিজিটাল সাইনটি বন্ধ করে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতা আবুল কাসেম আক্ষেপ করে আরো বলেন, পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও এসব অনিয়ম-দূর্নীতি কী দেখার জন্য কি কেউ নাই! হাসপাতালের অফিস সহকারী নেজাম উদ্দিন কাম হিসাব রক্ষক দীর্ঘ ২২ বছর যাবৎ পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে লুটেপুটে খাচ্ছে। কি আজব চাকুরী!

পেকুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও নানান অনিয়ম-দূর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে টিএইচও ডা: ছাবের আহমদ জানান, তিনি হাসপাতালে যোগদান করার পর থেকে হাসপাতালে রোগীরা আগের চেয়ে বেশী সেবা পাচ্ছে। হাসপাতালের প্রধান সহকারী নেজাম উদ্দিনের অনিয়ম-দূর্নীতি ও একই কর্মস্থলে ২২ বছর ধরে কিভাবে কর্মরত রয়েছে জানতে চাইলে বলেন, এ বিষয়ে তিনি ব্যবস্থা নিবেন।

 

পাঠকের মতামত: