বরাবরের মত রাত কিছুটা বাকী থাকতেই ঘুম ভাঙ্গল মাহমুদা বেগমের। বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে বাড়ির উঠানে নামেন তিনি। রাতের হাওয়ায় মেঘহীন পুর্বাকাশে শুকতারাটা ক্রমশঃ উজ্জল হয়ে উপরে উঠছে। পূর্ব দিগন্তজুড়ে এখনো গাঢ় অন্ধকার। অন্ধকার একটু ফিকে হলেই প্রথম উষার আভাষ, এরপর ফজরের প্রথম আজান, প্রতিদিন দেখে আসছেন তিনি। আঙ্গিনার একপার্শ্বে নলকুপে গিয়ে ওজু করে তাহাজ্জুদ নামাজে দাড়ালেন তিনি। তাহাজ্জুদ ও আরো নফল নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত। এরপর মোনাজাতে হাত তুললেন তিনি। ৬/৭ মাস আগে প্রয়াত হওয়া মানুষটির আত্নার শান্তির জন্য প্রার্থনা করে ছেলে-মেয়ে, জামাতাগন ও নাতী-নাতনীদের জন্যও দীর্ঘ মোনাজাত করলেন। মোনাজাতের পর জয়নামাজে বসে স্মৃতিকাতর হয়ে যান মাহমুদা বেগম। জীবনের এ পর্যায়ে এসে ফেলে আসা দিনগুলো উঁকি দেয় স্মৃতির জানালায়। বনেদী জমিদার পরিবারে জন্ম নিয়ে অঢেল প্রাচুর্যে বেড়ে উঠা তার। বাবা-চাচাদের সমন্বিত একান্নবর্তী পরিবারে চাচাত-জেঠাত-আপন ভাই বোনদের সাথে হৈ-হুল্লোড় ও বিপুল আনন্দে কেটেছে শৈশব-কৈশোর। স্কুলে মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতেই ক্রমাগত বিয়ের সম্বন্ধ আসতে লাগল। মুরুব্বীদের সিদ্ধান্তে একপর্যায়ে বিয়ে। বর পেশায় শিক্ষক, তাদের দুঃসম্পর্কীয় আত্নীয়। জ্ঞাতি এই আত্নীয় বংশের সাথে যাওয়া-আসা কমতে কমতে নাকি আত্নীয়তা মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। তাই এ বিয়ের মাধ্যমে পুরনো সম্পর্ক আবার তাজা হবে, এই ছিল মাহমুদা বেগমের দাদার অভিমত। ধুমধাম করে বিয়ের পর স্বামীর বাড়ীতে এসে পরম যত্নে সংসারটাকে গুছিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু প্রতিদিন সকালে শিক্ষক মানুষটা স্কুলে চলে গেলে এতবড় বাড়ী ভিটায় কেমন যেন শুন্যতা বোধ করতেন তিনি। সেই শুন্যতা পুরণ করতেই যেন একে একে ছয় ছেলে-মেয়ে দিয়ে বিধাতা তাদের সংসার ভরিয়ে দিলেন। ছেলে মেয়েদের শৈশব-কৈশোরে সবাই মক্তব-স্কুল-কলেজে পড়ত। প্রতিদিন ভোরে উঠে তাদের জন্য খাবার তৈরী, গোসল করানো, খাওয়ানো ও কাপড়-চোপড়ে পরিপাটি করে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর পর তিনি খেতে বসতেন। এর ফাঁকেই ছেলে মেয়েদের বাবা প্রস্তুত হয়ে স্কুলে চলে যেতেন। দুপুরের পর সন্তান-সন্ততিরা ও তাদের বাবা ফিরে এলে আবারো তাদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তবেই তার খাওয়া। সন্ধ্যার পর আবার সবাইকে পড়তে বসানো ও রাত হলে খাওয়া দাওয়ার পর ঘুমপাড়ানো। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়াসহ যাবতীয় ব্যাপারে সার্বিক তদারকীতে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এভাবেই কাটত তার ব্যস্ত সময়। সংসার সামলানোর এ শিক্ষাটা হাতে কলমে পেয়েছিলেন তার মায়ের কাছ থেকে। স্বামী মানুষটা শিক্ষকতা, নিজস্ব ব্যবসা ও সামাজিক কাজকর্ম নিয়ে রাতদিন ব্যস্ত থাকতেন। কোনরকমে বাজার সদাইটুকু করে দিয়েই তিনি বাইরের কাজে মন দিতেন। ছেলে-মেয়ে ও সংসার একাই সামলাতেন মাহমুদা বেগম। মায়ের কঠোর তত্বাবধানে এভাবে চলতে চলতে ছেলে-মেয়েরা বড় হয়ে সকলে উচ্চশিক্ষিত হয়েছে। সরকারী-বেসরকারী চাকরী, সাংবাদিকতা ও ব্যবসায় আজ তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তার মেয়েজামাইরা আর্মি অফিসার, অধ্যাপক, ব্যাংকার ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের বড়কর্তা। বাংলার অন্যসব মায়েদের মত সারাজীবন ছেলে মেয়েদের মানুষ করে তাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। সরকারী চাকরী থেকে এরি মধ্যে অবসর নিয়েছেন শিক্ষক স্বামী। অবসরপ্রাপ্ত মানুষটার পরিচর্যা ও টুকটাক সাংসারিক কাজে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। প্রতিবছর ঈদের পরে ও বিভিন্ন উৎসব-অনুষঙ্গে মেয়ে-জামাই-নাতী-নাতনীরা বেড়াতে এলে কয়েকদিন বাড়ীটা মুখরিত থাকে। দুষ্টু- মিষ্টি নাতী-নাতনীরা নানু বলতে অজ্ঞান। জামাতাগন আম্মা-আব্বা বলতে অজ্ঞান। বেড়ানো শেষে চলে গেলেও মেয়ে ও জামাতাগন সবসময়ই খবরাখবর নেয়। অবসরপ্রাপ্ত মানুষটার শরীর খুব একটা ভাল যাচ্ছিলনা কিছুদিন ধরে। মাহমুদা বেগমের নিজের শরীরেও বাসা বেঁধেছে বিভিন্ন রোগব্যধি। গত বছর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বাবা- মা দুজনকেই চিকিৎসা করিয়েছে ছেলেমেয়েরা। এরমধ্যে গত অক্টোবরে হঠাৎ বড়ধরনের ছন্দপতন ঘটল এতদিনের ছকবাঁধা জীবনে। ষ্ট্রোকপরবর্তী মাত্র একদিনের অসুস্হতায় স্বামী মানুষটা চলে গেলেন পরপারে। ছাত্র-সহকর্মী-আত্নীয়-স্বজন ও এলাকাবাসী সমবেত হয়েছিল বিশাল জানাজায়। এরপর কেটে যাচ্ছে দিনগুলি। সব সময়ই ছেলেমেয়ে ও জামাতারা খবর নেয়। সামান্য একটু অসুখ হলেই জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়, যেতে না চাইলে ডাক্তার বাড়ীতে আনে। তার পছন্দের খাবার ও ফলমুলে বোঝাই হয়ে আছে বাসার ফ্রীজটা। তিনি খেতে পারেননা, মানা করলেও শুনেনা তারা। বাজার থেকে একগাদা নাস্তা নিয়ে আসে, পাঠিয়ে দেয়। তাদের বাবা থাকতেও এরকম করত ছেলেমেয়েরা। কেবলমাত্র বছরের নির্দিষ্ট দিনকে মা দিবস-বাবা দিবস মানতে নারাজ তার উচ্চশিক্ষিত সন্তান-সন্ততিরা। তাদের ভাষায়, বছরের প্রতিদিনই মা দিবস, বাবা দিবস। বাবা মায়ের সেবাযত্ন করতে হবে প্রতিদিন, প্রতিক্ষন। পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্হায় ছেলে মেয়েদের সাথে শৈশবে বাবা মায়ের যোগসুত্র তেমন একটা থাকেনা বললেই চলে। বাবা-মায়েরা যার যার মত চলে, দুজনেই একাধিক বিয়ে করে, লিভ টুগেদার করে। তদের সন্তানরাও বড় হয় এলোমেলো ভাবে। তাই সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন সেখানে অনুপস্হিত। অার তাই অবধারিতভাবেই বৃদ্ধ অসহায় মা বাবার ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এর মধ্যে তথাকথিত মা দিবস বাবা দিবসে বছরের কেবলমাত্র একটা দিনে এরা বাবা মায়ের খবর নেয়, ওই দিন তারা ঘটা করে পালন করে মা দিবস, বাবা দিবস। আর সারা বছর বেখবর। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্হায় পারিবারিক বন্ধন শক্ত। বাবা মায়ের স্নেহ-শাসনে বড় হয় সন্তান-সন্ততিরা। তাই বড় হয়ে বৃদ্ধ বাবা মাকে পরম আদর-যত্ন, মায়া-মমতায় আগলে রাখে তারা। সারাবছর, প্রতিদিন, প্রতিক্ষনই এখানে মা দিবস, বাবা দিবস। আবহমান বাংলার পরিবার ব্যবস্হায় এ ধারা চলে আসছে হাজার বছর ধরে। তাই বছরের কেবলমাত্র একটি দিন মা বাবা দিবস পালন করা এখানে অযৌক্তিক। ছেলে-মেয়েদের উপর বাবা মায়ের হক্ব সারাজীবন, সারাবছর, সারাক্ষন। হাল আমলে পাশ্চাত্যের আমদানী করা ভিনদেশী বিজাতীয় সংস্কৃতির তথাকথিত মা দিবস বাবা দিবসের অসারতা নিয়ে ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে শুনা এসব কথা ভাবতে ভাবতে ফজরের আজান হতে শুনলেন মাহমুদা বেগম। শৈশব-কৈশোরে ভিতরে বাইরে সবসময় বাবা-মায়ের নিবিড় তদারকি-শাসন-পর্যবেক্ষন না থাকলে সন্তানরা মানুষ হতনা। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে মাহমুদা বেগমে ও তার স্বামীর মত লাখো মা-বাবা সারাজীবনের শ্রমে গড়েছেন সন্তানদের ভবিষ্যত। তাই আমাদের জন্য সারাবছরই মা দিবস, বাবা দিবস। কেবলমাত্র মে মাসের দ্বিতীয় রবিবারে তথাকথিত মা দিবসে “আই লাভ ইউ মম” বলা নিরেট ভন্ডামী ছাড়া কিছুই নয়।
==================
আতিকুর রহমান মানিক
সংবাদকর্মী ও সংগঠক,
ই মেইল – newspark14@gmail.com
মুঠোফোন – ০১৮১৮-০০০২২০
পাঠকের মতামত: