অনলাইন ডেস্ক :: রোহিঙ্গা ইস্যুতে যদি কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে ‘এলার্ম বেল’ বাজাবেন মিয়ানমার বিষয়ক জাতিসংঘের দূত ক্রিস্টিন শ্রানার-বার্গেনার। সোমবার তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়ার অগ্রগতি ধীরগতিতে এগুচ্ছে। এক্ষেত্রে যদি কোনো পদক্ষেপ নেয়া না হয় তাহলে এটা হবে এলার্ম বেল বাজানোর সময়। অন্যদিকে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা ব্যাখ্যা করতে মিয়ানমারের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল শিগগিরই বাংলাদেশে আসবেন বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত হাউ ডু সুয়ান। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে এক বৈঠকে সোমবার এসব কথা বলেছেন ক্রিস্টিন শ্রানার-বার্গেনার এবং হাউ ডু সুয়ান। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এপি ও এএফপি। মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, শিগগিরই, হতে পারে জুলাইয়ের শেষের দিকে, কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে তার সরকার একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল পাঠাবে। ওই প্রতিনিধিরা বাস্তুচ্যুত লোকজনের কাছে ব্যাখ্যা করবেন তাদের ফিরে যাওয়া ও পুনর্বাসনের জন্য কি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
প্রায় দুই বছর আগে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে কমপক্ষে ৭ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। কিন্তু তাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অগ্রগতির অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরব, সৌদি আরব থেকে যুক্তরাষ্ট্রÑ অনেক দেশের হতাশাজনক বক্তব্য ও প্রশ্নের বিষয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে কথা বলছিলেন ক্রিস্টিন শ্রানার-বার্গেনার। তিনি আরো বলেন, মাঠপর্যায়ে বড় ধরণের কোনো পরিবর্তন নেই। এক্ষেত্রে তিনি অনেক চ্যালেঞ্জের বিষয়ে ইঙ্গিত করেন। এর মধ্যে রয়েছে, সেখানকার বেসামরিক নেতাদের চরম প্রতিকূল পরিবেশ অতিক্রমের বিষয়। এমন পরিবেশে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক প্রভাব অব্যাহত রেখেছে মিয়ানমারের সেনবাহিনী। তা ছাড়া মিয়ানমারের ভিতরে রয়েছে অসংখ্য জটিলতা। এসব জটিলতা অন্তরায় হয়ে আছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গা সঙ্কট। তিনি মিয়ানমারের বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা ৭০ বছরের কথা উল্লেখ করেন। বলেন, সেখানে সক্রিয় রয়েছে ২১টি সশস্ত্র গ্রুপ। রয়েছে উন্নয়নের অভাব। সেখানে মাদক উৎপাদন হয়। সেখান থেকে মানব পাচার হয়।
ক্রিস্টিন শ্রানার-বার্গেনার বলেন, মিয়ানমারে বিদ্বেষপূর্ণ বৈষম্য ও সহিংসতা, বিশেষ করে রাখাইনের সহিংসতার ইতি ঘটানো রয়েছে তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে। রাখাইন রাজ্য হলো রোহিঙ্গাদের বসতি। সেখানে বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকরা পড়ে আছেন এক লাখ ২৮ হাজার বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা। তাদের অনেকে সেখানে আছেন প্রায় ৭ বছর ধরে। এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রাখাইনের লড়াই বন্ধে আরো অনেক বেশি করার আহ্বান জানান শ্রানার। তিনি বলেন, রাখাইনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াই বন্ধ করতে হবে। আরাকান আর্মি হলো একটি সুপ্রশিক্ষিত গেরিলা বাহিনী। তারা বৌদ্ধ জাতিগোষ্ঠীর একটি গ্রুপ। রাখাইনে শায়ত্তশাসন চায় তারা। শ্রানার বলেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের লড়াইয়ে ৩০ হাজার বৌদ্ধ ও মুসলিম বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, শরণার্থী সঙ্কটের একটিই সমাধান আছে। তা হলো তাদেরকে নিরাপদে, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। রাখাইনে এমন পরিবেশ সৃষ্টির মূল দায়িত্ব পড়ে মিয়ানমারের ওপর।
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা মুসলিমদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে দীর্ঘদিন বলে দাবি করে আসছে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার। এসব রোহিঙ্গা কয়েক প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করলেও তাদেরকে বাঙালি অভিহিত করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশী হিসেবে জাহির করে দেশটি। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের অধীনে তাদের কারো কোনো নাগরিকত্ব নেই। এর ফলে তারা হয়ে পড়েছেন রাষ্ট্রহীন। তাদের চলাফেরায় কোনো স্বাধীনতা নেই। নেই মৌলিক কোনো অধিকার। ২০১৭ সালের আগস্টে সন্ত্রাসী হামলার জবাবে সেনাবাহিনী ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ চালানোর পর রোহিঙ্গা সঙ্কট যেন আগ্নেয়গিরির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে। এর ফলে লাভার মতো রোহিঙ্গার ¯্রােত আসতে থাকে বাংলাদেশে। সেনাবাহিনী তাদের ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। গণহত্যা চালায়। পুড়িয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম। এ জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছে জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহ বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন।
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি পলিটিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ইলেন ফ্রেঞ্চ। তিনি বলেছেন, রাখাইনের অবস্থা উন্নয়নে খুব সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির অব্যাহত লড়াই দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে বেসামরিক জনগণের হতাহত হওয়ার ঘটনা। তিনি আরো জানান, রোহিঙ্গাদের এখনও ফিরে যাওয়ার মতো উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয় নি বলে মনে করে জাতিসংঘ, এর সঙ্গে একমত যুক্তরাষ্ট্র। রাখাইনে সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে রেখেছে। এতে সংশয় হয় তাদের পরিবেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি নিয়ে। যে পরিবেশে রোহিঙ্গারা নিরাপদে বসবাস করবেন।
ওই বৈঠকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত বলেন, রাখাইনে ফিরে যেতে আবেদন করেছে ৩০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা। এর মধ্যে প্রায় ১৩ হাজার ২০০ জনকে সাবেক অধিবাসী হিসেবে যাচাই করা হয়েছে। তারা যেকোনো সময় রাখাইনে ফিরতে পারবে।
পাঠকের মতামত: