ঢাকা,সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

দৃষ্টি প্রতিবন্ধী অন্নদাসের অন্ন জুটে গানের সুরে

নিজস্ব প্রতিবেদক, বান্দরবানের নীলাচল থেকে ফিরে ::

সত্যিই এক অসাধারণ গায়কি কন্ঠে গেয়ে যান একের পর এক গান। শুধু মাত্র গানের প্রথম কলি/লাইন বললেই হয়।এই অন্ধ অন্ন দাসের গানের সুর ভেসে বেড়ায় নীলাচল পাহাড়ের আকাশে বাতাসে। যেন পাহাড়ের চূড়ায় ডাকছে মনভোলানো গানের সুর।নিজে না তার গান না শুনতে কখনো  বিশ্বাস করার মতো নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানের অন্যতম পর্যটন স্পট নীলাচলে গান গেয়ে উপার্জিত অর্থে অন্ন জুটে শিল্পীর পরিবারের। দুটি পয়সা রোজগারের জন্য প্রতিদিন সন্তানের হাত ধরে আঠারো কিলোমিটার দূর থেকে নীলাচলে গান গাইতে আসে শিল্পী। তবে মজার বিষয় হচ্ছে ঢোল বাজিয়ে গান গেয়ে কখনো কারো কাছ থেকে কোনো টাকা পয়সা চায় না শিল্পী। বেড়াতে আসা ভ্রমণ পিপাসু মানুষজন গান শোনে মুগ্ধ হয়ে খুশি মনে দেয়া অর্থই শুধু হাসি মুখে গ্রহণ করে তিনি। বলছিলাম দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কন্ঠ শিল্পী অন্ন দাসের কথা। তার বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার ধর্মপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামে। প্রতিদিনই তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে পৌঁছে যান নীলাচলে। কখনো সন্ধ্যার আগে, আবার কখনো সন্ধ্যার পর তিনি ছেলের হাত ধরে ঢোল নিয়ে বাড়ির পথ ধরেন। বাড়ি থেকে নীলাচল আসা-যাওয়ায় প্রায় দেড়-দুঘন্টা সময় লাগে। প্রতিদিন ছেলে বা মেয়ে সহ দুজনের আসা-যাওয়ায় খরচও কম নয়। সবাইতো আর গান শুনে খুশি হয়ে টাকা দেয়না। মন চাইলে কেউ কেউ দেয়। বছরের অন্যসময় যেমন-তেমন, কিন্তু বর্ষাকালে খুব কষ্ট হয়। একদিন খায় অথবা আরেকদিন উপবাস। গত শুক্রবার নীলাচল পর্যটন স্পটে কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় চোখ ভাসান এ শিল্পী।
প্রতিবেদককে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অন্ন দাস বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাবা মায়ের সঙ্গে ভারতে পাড়ি দেবার সময় কালো জ্বরে চিকিৎসার অভাবে চোখ হারান এ শিল্পী।
তখন তার বয়স বড়জোর ছয়-সাত বছর। জন্ম থেকে অন্ধ ছিলোনা এ শিল্পী। এখন চোখে কিছুই দেখেনা, শুধুমাত্র চোখের সামনে আলোর একটি উপস্থিতি অনুভব করতে পারেন। তিনি বলেন, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিবন্ধী ভাতা পান। তবে ৩শ টাকা করে পাওয়া ভাতা ছয় মাস পর একসঙ্গে তোলেন তিনি। সংসারে তাঁর স্ত্রী এবং তিন ছেলে- মেয়ে আছে। সন্তানদের কেউ না কেউ প্রতিদিন বাবার সঙ্গে নীলাচলে আসে, তাই তারাও ঠিকমত পড়াশোনা করতে পারেনা। ঢোলের বাজনা এবং গান শোনে মুগ্ধ হয়ে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের কেউ কেউ তাকে ১০/২০ টাকা এবং অনেকে একশ থেকে দুইশ টাকাও দেন। দিনের শেষে ভালোবেসে দেয়া টাকার পরিমাণটা কখনো কখনো ৩শ থেকে ৫শ টাকা ছাড়িয়ে যায়। বেড়াতে আসা লোকদের দেয়া ভালোলাগার অর্থ দিয়েই চলে অন্ন দাসের সংসার।
নীলাচল ট্যুরিস্ট স্পটের ব্যবসায়ী মো: সায়দুল ও কর্মচারী মো: আজিজ বলেন, নীলাচলে উঠার সিঁড়িতে বসে গান করেন প্রতিবন্ধী অন্নদাশ। এখানে গান গাওয়ার জন্য কাউকে কোনো টাকা পয়সা দিতে হয়না তার। সবধরণের গান তিনি জানেন না। মূলত রেডিও এবং টেলিভিশনে গান শুনে শুনেই তাঁর গান শেখা। অনেক সময় বেড়াতে লোকজনেরা তাঁদের পছন্দের কোনো গান শুনতে চান। কিন্তু সেটি না পারলে তিনি ভদ্রতার সাথে ওই গানটি তিনি গাইতে পারেন না বলে জানিয়ে দেন। প্রতিবন্ধী অন্ন দাশ, ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে…মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা, গান গাই আমার মনরে বোঝাই, আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা, আগে কি সুন্দর দিন কাটাতাম এই গানগুলো বেশি গেয়ে থাকেন।
বেড়াতে আসা পর্যটক মাজেদ চৌধুরী, শরীফ সুমন, শারমিন বলেন, পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে শৈল্পিক ছোয়ার গড়ে তোলা নীলাচলের পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী অন্ন দাশের ঢোলের বাজনা এবং গানের সুর। আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পটটির সৌন্দর্য বর্ধণে ইট-কংক্রিটের বিভিন্ন শিল্পকর্ম, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, কটেজ, গোলঘর সহ অবকাঠামোগত কারুকাজে সাঁজানো হয়েছে। তবে সমস্ত আয়োজন যেন ছাপিয়ে যায় অন্ন দাশের ঢোলের বাজনা এবং গানের সুর। নীলাচল এবং অন্ন দাশ যেন মিলেমিশে একাকার। বান্দরবান ভ্রমনে এসে নীলাচল ঘুরতে গেলেই শোনা যায় ঢোলের বাজনা এবং গানের সুর। এখানে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী কন্ঠ শিল্পী অন্ন দাশ ভ্রমণপিপাসু মানুষদের ঢোল বাজিয়ে গান করে শোনান। অন্ন দাশের সঙ্গে ঢোল আর গানের সুরে কন্ঠ মেলান বেড়াতে আসা পর্যটকেরাও। এ যেন অন্যরকম এক আনন্দ। নীলাচলে বিনোদনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে এ শিল্পী।

পাঠকের মতামত: