ঢাকা,শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্নিত গুম, খুন, গ্রেফতার, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন বেড়েছে

4_13998অনলাইন ডেস্ক :

বাংলাদেশে গুম, মুক্তমনা ব্লগার খুন, রাজনৈতিক সহিংসতা, বিরোধী রাজনীতিকদের গ্রেফতার, নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধিসহ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে মানবাধিকার লংঘনের বড় ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। আন্তর্জাতিক এ মানবাধিকার সংস্থা বলেছে, স্বাধীন গণমাধ্যমকে চাপে রাখায় দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে গত বছর সরকারবিরোধী আন্দোলনে পেট্রলবোমা হামলায় হতাহতের ঘটনাগুলোকে মানবাধিকারের চরম লংঘন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার প্রকাশিত অ্যামনেস্টির মানবাধিকারবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে ২০১৫ সালে মানবাধিকারের বৈশ্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে স্বাধীন গণমাধ্যম মারাত্মক চাপের মুখে রয়েছে। বাক-স্বাধীনতা বিঘ্নিত হচ্ছে। সরকার কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, তারা যেন দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন না দেয়। বিজ্ঞাপন দিলে তারা শাস্তির মুখোমুখি হবে। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওই পত্রিকা দুটি সমালোচনামূলক অবস্থানের জন্য পরিচিত। প্রতিবেদনে গণমাধ্যমের ওপর চাপ ছাড়াও মত প্রকাশে আরও কিছু অন্তরায়ের উদাহরণ তুলে ধরা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়, সংসদের সমালোচনা করায় গত নভেম্বরে একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করে। এছাড়া বিচার ন্যায়নিষ্ঠ হয়নি মন্তব্য করায় ঢাকার একটি আদালত সুশীল সমাজের ৪৯ জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বাধীন সরকারবিরোধী আন্দোলন সংঘাতে রূপ নেয়। এ সময় যাত্রীবাহী বাসসহ কয়েশ’ পরিবহনে পেট্রলবোমা হামলা হয়। এতে অসংখ্য আরোহী নিহত হন। অনেকেই আহত হয়েছেন। এই সহিংসতার সঙ্গে সরাসরি জড়িত কাউকে বিচারের আওতায় আনা যায়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদেও গ্রেফতার প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির সিনিয়র নেতাদের বারবার গ্রেফতার করা হয়েছে। বাদ পড়েনটি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। সর্বশেষ মুক্তি পাওয়ার আগে তাকে বারবার গ্রেফতার করা হয়েছে। মির্জা ফখরুলসহ শত শত গ্রেফতার নেতাকর্মীকে নাশকতার মামলার আসামি করা হয়েছে।

গুম প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাদা পোশাকের আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা ডজন ডজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। পরে তাদের অবস্থান সম্পর্কে তারা জানে না বলে দাবি করেছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে দুই নারীসহ ৪৩ ব্যক্তি গুম হয়েছেন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬ জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে, ৫ জনকে পুলিশ কাস্টডিতে পাওয়া গেছে। ৪ জনকে অপহরণের পর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ২৮ জনের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা আজও জানা যায়নি। গুম ও নিরীহ ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় জড়িত আইনশৃংখলা বাহিনীর কোনো সদস্যকে বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

প্রতিবেদনে আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ওই বাহিনীর নিরীহ লোকদের নির্র্যাতন ও পুলিশ কাস্টডিতে নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েছে। এসব নির্যাতনের অভিযোগগুলোর তদন্ত খুব কমই হয়েছে। পুলিশের অপরাধের তদন্ত হয় না বললেই চলে।

গত বছর ব্লগার ও প্রকাশক হত্যা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রাখার ঘটনা মত প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, ব্লগাররা তাদের ধর্মনিরপেক্ষ মত প্রকাশ করায় ইসলামি জঙ্গিদের হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন। সরকারি কর্তৃপক্ষ এমনকি প্রধানমন্ত্রী লেখালেখির মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার জন্য ব্লগার ও প্রকাশকদের অভিযুক্ত করেছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

বিদেশী হত্যা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর সময়কালে বেশ কয়েকজন বিদেশী দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়েছেন। একজন ইতালীয় নাগরিক ও একজন জাপানি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত এবং অপর একজন ইতালীয় ডাক্তার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। শিশু সামিউল ইসলাম রাজনকে চুরির অভিযোগে প্রকাশ্যে পিটিয়ে খুন করা হয়- যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে অন্তত ১৬ জনকে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও সেটা কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল ওইমেন লয়ার অ্যাসোসিয়েশনের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ২৪০ জনেরও বেশি নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, সম্প্রতি ধর্ষণের ঘটনাগুলো বেড়ে গেলেও যথাসময়ে সঠিক তদন্ত না হওয়ায় বিচার হচ্ছে না।

মৃত্যুদণ্ড দেয়া প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তত ১৯৮ জনকে বিভিন্ন অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রাজন হত্যা মামলায় ৬ জনকে, পুলিশ কর্মকর্তা পিতাকে হত্যার দায়ে ঐশীকে এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় ৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।

দ্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট ২০১৫/১৬ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৬০ দেশ ও অঞ্চলের ২০১৫ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে।

পাঠকের মতামত: