ঢাকা,মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

ভুল চিকিৎসয় শিশু রাইফার মৃত্যুর অভিযোগ: চট্টগ্রামে হঠাৎ ঐক্যবদ্ধ সব দলের চিকিৎসকরা

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি ::

চট্টগ্রামে ‘ভুল চিকিৎসয়’ প্রায় আড়াই বছর বয়সী শিশুকন্যা রাইফা খানের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত সমর্থক চিকিৎসকরা এক হয়েছেন। সরকার দলীয় চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সঙ্গে রাজনৈতিক কারণে দূরত্ব রয়েছে বিএনপির ড্যাব ও জামায়াতে ইসলামীর চিকিৎসক সংগঠন এনডিএফের। কিন্তু সমকালের সাংবাদিক রুবেল খানের শিশুকন্যা রাইফার মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তাধীন থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক দূরত্ব ঘুচিয়ে চট্টগ্রামে হঠাৎ ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন স্বাচিপ, ড্যাব, এনডিএফ নেতাসহ চিকিৎসকরা। তবে এ নিয়ে সাধারণ চিকিৎসক সংগঠনগুলোসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

অনেকে বলেছেন, দীর্ঘদিন পর চট্টগ্রামে চিকিৎসক সংগঠনগুলো একত্রিত হওয়ার লক্ষ্য একটাই, তা হলো নিজেদের পেশাগত ‘স্বার্থ’। বেসরকারি ম্যাক্স হাসপাতালের পরিচালনায় যাঁরা রয়েছেন তাঁদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থক। ওই হাসপাতালে শিশু রাইফার ‘ভুল চিকিৎসয়’ মৃত্যুর অভিযোগ তদন্ত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে অন্য একটি কমিটি। তবে এখনো তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। এ ছাড়া ওই হাসপাতালের একটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। যেকোনো সময় তদন্ত কমিটিগুলোর প্রতিবেদন দাখিল করার কথা রয়েছে। প্রতিবেদন ‘প্রভাবিত’ করতেই অর্থাৎ অভিযুক্ত হাসপাতাল ও চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রক্ষা করতেই সব চিকিৎসক সংগঠন হঠাৎ এক হয়েছে বলে অনেকের অভিমত।

জানা গেছে, তদন্ত প্রতিবেদনে ভুল চিকিৎসর অভিযোগ প্রমাণিত হলে জড়িতদের বাঁচাতে বড় ধরনের কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা নিচ্ছে চট্টগ্রামের চিকিৎসক সংগঠনগুলো। এরই মধ্যে চট্টগ্রামে গত কয়েক দিনে তাদের পালন করা সভা-সমাবেশগুলোতে এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে একাধিক রুদ্ধদ্বার বৈঠকও হয়েছে। ওই কর্মসূচিগুলোতে চিকিৎসক নেতারা শিশু রাইফার মৃত্যুর বিচারের দাবিতে সাংবাদিক সংগঠনসহ আন্দোলনরতদের উদ্দেশে হুঁশিয়ারি দেন।

গত বুধবার রাতে বিএমএ চট্টগ্রামের উদ্যোগে নগরের জিইসি মোড়ে পেশাজীবী ওই সংগঠনের নিজস্ব ভবনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিএমএ, স্বাচিপ, ড্যাব ও এনডিএফ নেতারা বক্তব্য দেন। সভায় কয়েক শ চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

বিএমএ চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুল হক খানের সভাপতিত্বে ওই সভা হয়। তিনি স্বাচিপ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ শাখারও সভাপতি। এতে বক্তব্য দেন বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাধারণ সম্পাদক ও স্বাচিপ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী, ড্যাব চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ শাখার সভাপতি ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী ও একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ডা. তমিজ উদ্দিন মানিক, এনডিএফ চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. খায়রুল আনোয়ার, একই কমিটির সাবেক সভাপতি ডা. এ কে এম ফজলুল হক প্রমুখ। তাঁদের মধ্যে ডা. ফয়সাল মহানগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যবিষয়ক সম্পাদক, ডা. খুরশিদ বিএনপি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কমিটির নির্বাহী সদস্য।

এ ছাড়া সভায় আওয়ামী লীগ সমর্থক পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ও স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. এল এ কাদেরী, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ইমরান বিন ইউনুছ, সাবেক উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আবদুল আলিম, ড্যাব চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. জসিম উদ্দিন প্রমুখ বক্তব্য দেন।

তবে বিএমএ চট্টগ্রামের ওই সভায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থক নেতাদের প্রায় সবাই অংশ নিলেও স্বাচিপ কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক চট্টগ্রামের চিকিৎসক নেতা ডা. মিনহাজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন অংশ সেখানে যায়নি।

গত বুধবার রাতে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিএনপি ও ড্যাব নেতা ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরীর বক্তব্য নিয়ে চট্টগ্রামে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ডা. খুরশিদ জামিলের ওই বক্তব্য নিয়ে খোদ বিএনপি নেতারাও বিব্রত বোধ করছেন। ওই বক্তব্য বিএমএর সঙ্গে সাংবাদিকদের সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়ার শামিল বলে অনেকে মন্তব্য করেন। বক্তব্যে চিকিৎসকদের আন্দোলন আরো জোরদার করাসহ বিভিন্ন উসকানিমূলক কথাও বলেন ডা. খুরশিদ। সাংবাদিকদের মারধর করা, স্ট্রাইক করাসহ নানা উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে বিএমএকে সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের মুখোমুখি করার কথা বলেছেন।

ডা. খুরশীদ জামিল চৌধুরী বিএনপি সমর্থক সম্মিলিত পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের চট্টগ্রামের সদস্যসচিব। তাঁর এই বক্তব্য নিয়ে ওই সভায় বিএমএ, স্বাচিপ ও এনডিএফের কোনো নেতা কথা বলেননি। কেউ প্রতিবাদও করেনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সহসভাপতি নাজিম উদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে বলেন, ‘ওনার (ডা. খুরশিদ জামিল চৌধুরী) বক্তব্যে আমরা বিব্রত। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মী হতাশ, ক্ষুব্ধ। এই সময়ে এসে ওনার মতো একজন নেতার এ ধরনের বক্তব্যের কারণে আমরাও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি। এটা দ্রুত ছড়াচ্ছে। আমাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সুযোগ নিচ্ছে। তাঁর এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া কিছুতেই মানা যায় না।’

বিএমএ চট্টগ্রামের সভাপতি অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক খান গত রাতে বলেন, ‘রাইফার মৃত্যু নিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা করতে বুধবার রাতে আমরা একটি মতবিনিময়সভার আয়োজন করেছি। বিএমএ চিকিৎসকদের সর্বজনীন সংগঠন। এখানে সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ের চিকিৎসক উপস্থিত ছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরাও চাই রাইফার মৃত্যুর সঠিক তদন্ত। তদন্তে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে তাতে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। কিন্তু বিএমএ নেতাদের বিরুদ্ধে যে অশোভন আচরণ করা হয়েছে এবং এখনো করা হচ্ছে তার আমরা প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি।’

ম্যাক্স হাসপাতালে সাংবাদিক রুবেল খানের শিশুকন্যা রাইফা খানের অকালমৃত্যুতে বিএমএ চট্টগ্রাম আয়োজিত ওই সভার শুরুতে শোক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করা হয় বলে গত রাতে বিএমএ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। এতে আরো বলা হয়, রাইফার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের নামে ব্যক্তিগত চরিত্র হরণ করে মিথ্যা অপপ্রচার বন্ধ করার দাবিসহ সভায় চারটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বিশেষজ্ঞ প্যানেল দিয়ে রাইফার মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত এবং তদন্তে অভিযুক্ত চিকিৎসক, নার্স বা প্রতিষ্ঠান বা কোনো ব্যক্তি দোষী সাব্যস্ত হলে আইনের আওতায় এনে আইনানুগ ব্যবস্থার দাবি জানানো হয় সভায়। এ ছাড়া রাইফার মৃত্যুর ঘটনায় ভুল চিকিৎসর অভিযোগে কর্তব্যরত চিকিৎসককে নাজেহাল ও লাঞ্ছিত করে পুলিশে সোপর্দ করে থানাহাজতে প্রেরণের নিন্দা এবং আইন হাতে নিয়ে চিকিৎস প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানানো হয়। ম্যাক্স হাসপাতালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির সামনে আমন্ত্রিত বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. মুজিবুল হক খানের সঙ্গে সাংবাদিক নেতাদের অশোভন আচরণের তীব্র নিন্দা জানানো হয়। এতে বলা হয়, বিএমএ চট্টগ্রাম শাখা সাধারণ সম্পাদক ডা. মো. ফয়সল ইকবাল চৌধুরী কখনো সাংবাদিক বা তাঁদের পরিবারবর্গের চিকিৎসসেবা করবেন না বলে কোনো বক্তব্য বা ঘোষণা দেননি।কালের কণ্ঠ

 

পাঠকের মতামত: