ঢাকা,মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

দেশেই ইয়াবার কারখানা : সহজেই মিলছে নিষিদ্ধ উপকরণ

ডেস্ক নিউজ :

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ছে ইয়াবার লেনদেন। ঢাকায় এর আগ্রাসন আরও বেড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি, ইয়াবা আসছে মিয়ানমার থেকে। তবে সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়ায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, ‘এটা খুব ভীতিজনক বার্তা। এর কাঁচামাল বিক্রি ও আমদানিও নিষিদ্ধ। তাই এর লাগাম টানতে হবে এখনই।

মাদকাসক্ত তরুণ-তরুণীদের কাছে ইয়ারা ‘ক্রেজি মেডিসিন, ‘হিটলার চকলেট’ নামে পরিচিত। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন ইয়াবা ভয়ঙ্কর একটি নেশা যা পুরো যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে বলে অভিমত চিকিৎসক ও নিরাময় কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের।

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় এক সংসদ সদস্যের বক্তব্যে মাদক ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কার্যক্রম নিয়ে সমালোচনার পর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় রাজধানীসহ সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের নেতৃত্বে এপিবিএন ও পুলিশের সহয়াতায় নারায়ণগঞ্জে সাঁড়াশি অভিযান চালানো হয়। অভিযানে বন্দর থানাধীন হরিপুর গ্রামে একটি টিনসেড বাড়িতে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান মেলে। অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে মূলহোতা হাবিবুর রহমান পালিয়ে গেলেও ধরা পড়ে তার স্ত্রী লাকী আক্তার।

অভিযানে নেতৃত্বদানকারী নারায়ণগঞ্জ সার্কেলের সহকারী পরিচালক (এডি) বিপ্লব কুমার মদক জাগো নিউজকে বলেন, অভিযানে টিনসেড বাড়ির তিনটি কক্ষের প্রত্যেকটিতে ইয়াবা তৈরির উপকরণ মজুদ পাওয়া গেছে। একটি কক্ষে পাওয়া যায় ইয়াবা তৈরির মেশিন। পুরো বাড়িটি সিসি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

‘ওই বাড়ির বাসিন্দা হাবিবুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা তৈরি করে আসছিল। তিনি নিজ নেটওয়ার্কে ইয়াবা সাপ্লাই দিতেন। তাকেও ধরার চেষ্টা চলছে।’

বিপ্লব কুমার মদক আরও বলেন, ইয়াবা তৈরির মূল উপকরণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মিথাইল অ্যামফিটামিন এবং ক্যাফেইন। ইয়াবাতে ২৫-৩৫ মিলিগ্রাম মিথঅ্যামফিটামিন এবং ৪৫-৬৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে। ওষুধ প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী এটাকে বলা হয় সিউডোফেড্রিন। এটি ব্যবহার করেই ইয়াবা তৈরি হচ্ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, সিউডোফেড্রিন এলকালয়েড (উপক্ষার) এফেড্রিনের একটি রাসায়নিক জাতক। এফেড্রিন এলকালয়েডকে হাইড্রোক্লোরিক এসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া করলে সিউডোফেড্রিন তৈরি হয়। সর্দি-কাশির ওষুধ তৈরির উপাদান সিউডোফেড্রিন ব্যবহৃত হয়। ফুসফুস, কান-গলার প্রদাহ, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট ও অ্যালার্জি উপশমের ওষুধে সিউডোফেড্রিন ব্যবহার হয়।

আমদানি করা সিউডোফেড্রিন দিয়ে আট ধরনের ওষুধ প্রস্তুত করে স্থানীয় ওষুধ কোম্পানি। তবে এ সিউডোফেড্রিনের সঙ্গে ক্যাফেইন মিশিয়ে মাদকদ্রব্য তৈরি হচ্ছে। সিউডোফেড্রিন দিয়েই মেটাফেটামিন তৈরি করা হয়, যা ইয়াবা নামে পরিচিত। মেটাফেটামিন ও ক্যাফেইন দিয়েই ইয়াবা তৈরি হয়।

তরুণ সমাজকে ধংসের জন্য প্রতিবেশী কয়েকটি দেশ প্রচুর পরিমাণে সিউডোফেড্রিন উৎপাদন করছে এবং তা দিয়ে ইয়াবা তৈরির পর দেশে পাচার করা হচ্ছে।

সিউডোফেড্রিন ওভার দ্য কাউন্টার ওষুধ বা সেসব ওষুধ যেগুলো শুধু প্রেসক্রিপশন নয়, এটি কিনতে সরকারি অনুমোদন লাগে। বিশ্বজুড়ে সিউডোফেড্রিন ব্যাপক অপব্যবহারের কারণে এ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ইয়াবা ট্যাবলেটের বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় সিউডোফেড্রিন সম্প্রতি নিষিদ্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের চিফ কনস্যালটেন্ট ডা. সৈয়দ ইমামুল হোসেন বলেন, ইয়াবা সেবনে প্রাথমিক অবস্থায় যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধির পাশাপাশি ঘুম ও ক্ষুধা কম হয়। এজন্যই যুব সমাজ ইয়াবা সেবনে উৎসাহিত হয়ে থাকে। ইয়াবা সেবনে সৃষ্ট যৌন উত্তেজনা সীমিত সময়ের জন্য অনুভূত হয়। এক-দুই বছরের মধ্যে ইয়াবা সেবনকারীদের যৌন উত্তেজনা চিরতরে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যা পরে চিকিৎসা করলেও অনেক সময় অবস্থার উন্নতি হয় না। ইয়াবা সেবনকারীরা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে, স্বাভাবিকভাবেই তারা মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। অস্থিরতার কারণে তারা যেকোনো অঘটন ঘটাতে পারে। মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তার কারণে মুখের অভ্যন্তর সাধারণত অ্যাপথাস আলসার থেকে শুরু করে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ইয়াবা প্রতিরোধে অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের প্রতি খেয়াল রাখা।

এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এম এ রব জাগো নিউজকে বলেন, দেশে যদি ইয়াবারসেবী কিংবা চাহিদা বাড়ে তাহালে কোনো না কোনোভাবে এর সরবরাহও বাড়বে। আর সেটাই হচ্ছে।

দেশে ইয়াবা তৈরির কারখানার পেছনে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাহিদা পূরণ ও ব্যবসা সফল করতে মাদক ব্যবসায়ীরা তো নানা অপকৌশল নিবেই। লো কস্টে যদি দেশেই ইয়াবা তৈরি ও দ্রুত সাপ্লাই দেয়া যায় তাহলে তো মাদক ব্যবসায়ীরা সফল। তাদের বিফল করতে তো অভিযান দরকার। স্রোতের ন্যায় রোহিঙ্গা আসছে। তাদের সঙ্গে আসছে ইয়াবাও। এরমধ্যে যদি দেশে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান মেলে এটা ভয়াবহ ঘটনা। এর লাগাম টানতে হবে এখনই। সেজন্য এককভাবে নয় সকল বাহিনীকে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে কাজ করার উচিত বলে মনে করি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, দেশে ইয়াবা তৈরি হয় না এ ধারণা বদলে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জে ইয়াবা তৈরির কারখানার সন্ধান মেলার পর নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এটা খুব ভীতিজনক বার্তা।

তিনি আরও বলেন, ইয়াবার ভয়াবহতা অনুভব করে এর আগ্রাসন রোধ ও মাদক নির্মূলে সরকার সিউডোফেড্রিন আমদানি, মজুদ ও বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। এরপরেও এটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

তিনি বলেন, এটা বাজারে পাওয়ার কথা না। এটি ইয়াবার ন্যায় সীমান্ত দিয়েই দেশে আসছে বলে মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে স্পট ধরে ও মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা নিয়ে অভিযান শুরু হয়েছে বলেও জানান তিনি।

পাঠকের মতামত: